‘দায় কিশোরীর একার নয়’
১৯ আগস্ট ২০১৩পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান এবং তাঁর স্ত্রী স্বপ্না রহমান তাঁদের নিজ সন্তান ***-র হাতে খুন হয়েছেন, অভিযোগ এমনটাই৷ আর এ নিয়ে দেশের সংবাদমাধ্যমই শুধু নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিস্তর আলোচনা৷ বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন সমাজবিজ্ঞানী এবং মনস্তত্ত্ববিদরাও৷ এই হত্যকাণ্ড কোনো সাধারণ হত্যাকাণ্ড নয়৷ এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে সমাজ ও পরিবারের নানা দিক, নানা অসঙ্গতি৷
অভিযুক্ত ***-র বয়স ১৭৷ সে ভয়াবহ মাদক ইয়াবায় আসক্ত৷ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, মেয়েদের মাদক গ্রহণের পরিমাণ এখন উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে৷ দেশে ৮০ লাখ মাদকাসক্তের ৩০ ভাগই এখন মেয়ে৷ তাদের বয়স ১৪ থেকে ২১ বছরের মধ্যে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইয়াবার প্রচলনের কারণে মেয়েদের মধ্যে এই মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে৷ ইয়াবা বহন এবং সেবন দুটোই সহজ৷ এছাড়া হতাশা, কৌতূহল এবং বন্ধু-বান্ধবের কারণে তারা ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ছে৷
ডা. তাজুল ইসলাম জানান, উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ বিত্ত পরিবারের সন্তানরাই ইয়াবায় বেশি আসক্ত হচ্ছে৷ এর প্রধান কারণ, ইয়াবার দাম বেশি৷ তাঁর মতে, ***-র ইয়াবা আসক্তির পর তার বাবা-মা তাকে আটকে রাখত৷ হয়ত একজন মাদকাসক্তকে চিকিত্সা না দিয়ে আটকে রাখার কারণে তার মধ্যে প্রতিহিংসার জন্ম নেয় এবং এই নির্মম ও করুণ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে৷ বলা বাহুল্য, মাদকাসক্তের চিকিত্সা সম্পর্কে ধারণা না থাকায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷ তাকে যদি চিকিত্সা দেয়া হতো, তাহলে হয়ত এই ঘটনা নাও ঘটতে পারত৷ কারণ মাদকাসক্তকে চিকত্সা না দিয়ে আটকে রাখলে তার শরীরে এবং মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া এবং যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়৷ আর যারা তাকে আটকে রাখেন, তাদের চরম শত্রু মনে করে প্রতিশোধ নিতে চায় তারা৷
অধ্যাপক তাজুল ইসলাম বলেন, পারিবারিক অবহেলাসহ নানা কারণে তরুণ-তরুণীরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে৷ বাবা-মা ব্যস্ততার কারণে সন্তানকে সময় দেন না, যা তাদের মধ্যে বঞ্চনা ও ক্ষোভ তৈরি করে৷ বাবা-মা খোঁজ রাখেন না যে তাদের সন্তান কোথায় যায়, কাদের সঙ্গে মেশে, তার বন্ধু কারা৷ এসব কারণেই বিপর্যয় নেমে আসে৷ ***-র ক্ষেত্রেও হয়ত সেটাই হয়েছে৷
তিনি বলেন, ‘গুড পেরেন্টিং' এবং সন্তানের সঙ্গে ‘কোয়ালিটি সময়' কাটানো খুব জরুরি৷ এছাড়া, সন্তানের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যেমন যাবে না৷ তেমনই তাদের অপমান অপদস্থ করা যাবে না, করা যাবে না অবহেলাও৷ তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতে হবে৷ তাদের ভালো কাজের প্রশংসা করতে হবে৷ তাদের কাছ থেকে বন্ধু হয়েই জানতে হবে তাদের মনের কথা৷ আর বন্ধু হয়েই করতে হবে সহযোগিতা৷ তাহলে তারা আর অন্ধকার জগতে পা বাড়াবে না৷
অধ্যাপক তাজুল ইসলাম বলেন, *** তার বাবা-মাকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে৷ কিন্তু তাকে নিয়ে রগরগে কাহিনি প্রকাশ করা সংবাদমাধ্যমের কোনোভাবেই ঠিক হবে না৷ বিষয়টি দেখতে হবে অ্যাকাডেমিকভাবে৷ এ নিয়ে আলোচনা হতে হবে৷ হতে হবে প্রতিবেদন৷ তবে তা যেন হয় আমাদের সমাজের, পরিবারের এই সংকটকে দূর করার লক্ষ্য নিয়ে৷ আর *** যেহেতু প্রাপ্তবয়স্ক নয়, তাই তার জন্য যে আইন আছে সেই আইনেই তার বিচার হতে হবে৷
শুধু তাই নয়, সংবাদমাধ্যমে তার ছবি প্রকাশেরও বিরোধিতা করেন তাজুল ইসলাম৷ বলেন, মনে রাখতে হবে মাদকাসক্তি একটি রোগ৷ তাই এই মাদকসক্তির বিরুদ্ধেই কাজ করতে হবে৷
*** জার্মানির গণমাধ্যম নীতিমালা অনুসরণ করে আলোচিত কিশোরীর নাম, ছবি প্রকাশ করা হয়নি৷