1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

জেগেছে 'ইন্ডিয়া' শিবির, ভোট পাবে কি?

পায়েল সামন্ত কলকাতা
২ এপ্রিল ২০২৪

দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী গ্রেপ্তার হওয়ার পর উজ্জীবিত দেখাচ্ছে ঝিমিয়ে পড়া 'ইন্ডিয়া' শিবিরকে। লোকসভা নির্বাচনে এর কোনো প্রভাব পড়বে?

https://p.dw.com/p/4eLhv
দিল্রিতে আইএনডিআইএ বা ইন্ডিয়া জোটের সমাবেশ
কেজরিওয়াল গ্রেপ্তার হওয়ার পর আরো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে বিরোধীরাছবি: P. Mishra/DW

আবগারি দুর্নীতি মামলায় দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করেছে এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট। এখন তিহাড় জেলে রয়েছেন তিনি। আম আদমি পার্টির এই শীর্ষ নেতার গ্রেপ্তারির পর বিজেপি বিরোধী শিবির গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। ঐতিহাসিক রামলীলা ময়দানে গত রবিবার ইন্ডিয়া জোটের জমায়েত ছিল নজরকাড়া।

রামলীলার বার্তা

দিল্লির সমাবেশের উদ্যোক্তা ছিল সেখানকার ক্ষমতাসীন দল আপ। তবে তা বিরোধী জোটের পূর্ণাঙ্গ সমাবেশের চেহারা নেয়। দিন দশেক আগে মুম্বইয়ে 'ইন্ডিয়া' শিবিরের সভা হয়েছিল। কিন্তু ধারে ভারে রামলীলার সমাবেশ সাম্প্রতিক অতীতের সব বিরোধী জমায়েতকে ছাপিয়ে গিয়েছে।

কংগ্রেস, বাম, সমাজবাদী পার্টি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল, তৃণমূল কংগ্রেস, ন্যাশনাল কনফারেন্স, ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা, ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি, শিবসেনা সহ ২৭টি দলের প্রতিনিধি হাজির ছিলেন আম আদমি পার্টির ডাকা সমাবেশে। ছিলেন কেজরিওয়ালের স্ত্রী সুনীতা ও জেলবন্দি ঝাড়খণ্ডের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের স্ত্রী কল্পনা।

মঞ্চে উপস্থিত সব নেতা কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারির প্রতিবাদ জানিয়েছেন। একই সঙ্গে ডাক দিয়েছেন 'গণতন্ত্র রক্ষার'। কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী থেকে আরজেডির তেজস্বী যাদব, সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি থেকে শিবসেনার উদ্ধব ঠাকরে, সকলেই বিজেপিকে হারানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

দিল্লিতে বি রোধীদের সমাবেশ
পর্যবেক্ষকদের একাংশ মনে করছেন, বিজেপির দুর্নীতিবিরোধী প্রচার খুব একটা ফলপ্রসূ হবে নাছবি: P. Mishra/DW

অন্যান্য বিরোধী দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব উপস্থিত থাকলেও তৃণমূল কংগ্রেস পাঠিয়েছিল দিল্লির দুই নেতাকে। রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও ব্রায়েন এবং সদ্য সাংসদ হওয়া সাগরিকা ঘোষ। দলের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সেকেন্ড ইন কম্যান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় রবিবার একই সময়ে লোকসভা নির্বাচনের প্রচার করছিলেন পশ্চিমবঙ্গে।

সব নেতাই কেজরিওয়াল ও সোরেনের মুক্তির দাবি তুলেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "নির্বাচন ঘোষণার পর কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারির জন্য খুব বাজে সময় বেছে নিয়েছে কেন্দ্রীয় সংস্থা। এটা বিজেপির কাছে বুমেরাং হতে পারে।"

পর্যবেক্ষক মইদুল ইসলাম ডিডাব্লিউকে বলেন, "ফেয়ার গেম হচ্ছে না, এটা বিরোধীরা বলতেই পারে। ভোটের মুখে এসব কেন হচ্ছে? আগেও তো হতে পারতো। তারা ভিকটিম কার্ড সামনে রাখবে। তাতে ভোটে বিরোধীদের সুবিধা হতে পারে।"

আদৌ কি ঐক্যবদ্ধ?

বিজেপির বিরুদ্ধে বিভিন্ন দলের নেতাদের এক জায়গায় আসার ছবিটা নতুন নয়। রাজ্যে রাজ্যে পরস্পর যুযুধান নেতৃত্ব একই মঞ্চে বসেছেন ইন্ডিয়া শিবিরের অধীনে। সেই ছবি আরেকবার দেখা গেল রামলীলা ময়দানে। কিন্তু তাতে যে জোটের শরিকদের দূরত্ব মিটছে না, তা বোঝা যাচ্ছে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে।

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস ও বামেরা বিজেপির বিরুদ্ধে আসন সমঝোতা করে ভোটে লড়ছে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, "আমি ইন্ডিয়া জোট তৈরি করেছি। ভোটের পর সেটা আমি বুঝে নেব। এখানে আমি একলা লড়ছি। সিপিএমকে ভোট দেয়া মানে বিজেপিকে ভোট দেয়া। কংগ্রেসকে ভোট দেয়া মানেও বিজেপিকে ভোট দেয়া।"

‘কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারি আপের প্রতি সহানুভূতি বাড়াচ্ছে’

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ও বিদায়ী লোকসভায় দলের নেতা অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, "তৃণমূল এমন কিছু করবে না যাতে বিজেপির সমস্যা হয়। তাই তারা ইন্ডিয়া জোটে থেকেও নেই। ভোটের জন্য এখন একই মঞ্চে বসছে। কিন্তু ইডি, সিবিআইয়ের হাত থেকে বাঁচতে বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।

এতটা তিক্ত না হোক, পারস্পরিক বিরোধিতার ছবি রাজ্যে রাজ্যে রয়েছে। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, কর্নাটকের মতো রাজ্যে সরাসরি বিজেপি বনাম কংগ্রেসের লড়াই। সেখানে তৃতীয় শক্তি তেমন উল্লেখযোগ্য না হওয়ায় সমস্যা নেই। কিন্তু যেখানে ইন্ডিয়া জোটের দুই বা তিন শরিকের শক্তি আছে, জট তৈরি হয়ে আছে সেখানে।

এই জট কোনো কোনো জায়গায় ছাড়ানো গিয়েছে। দিল্লিতে আপ ও কংগ্রেস একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে বিজেপি বিরোধিতায়। সেখানকার সাতটি লোকসভা কেন্দ্রে তাদের মধ্যে আসন সমঝোতা হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেসের মধ্যে বোঝাপড়া চূড়ান্ত। মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস, এনসিপি ও শিবসেনার মধ্যে জোট হয়েছে। বোঝাপড়া হয়েছে বিহার ও ঝাড়খন্ডে।

কিন্তু দিল্লির পাশে পাঞ্জাবে আপ ও কংগ্রেস একে অপরের বিরুদ্ধে ভোটে লড়ছে। কেরলে বাম ও কংগ্রেস পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। পশ্চিমবঙ্গের একাধিক আসনে কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। অর্থাৎ আঞ্চলিক রাজনীতির বাধ্যবাধকতার উপরে উঠে বোঝাপড়া সম্ভব হচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রেই।

প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডিডাব্লিউকে বলেন, "যখন প্রথম ইন্ডিয়া জোটের ঘোষণা হয়, তখন যা মনে হয়েছিল, তার ধারেকাছে বিরোধীরা পৌঁছাতে পারেনি। কেজরিওয়ালকে কেন্দ্র করে আবার তারা জেগেছে ঠিকই, কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। এখন আর একজোট হয়ে মানুষের কাছে পৌঁছনোর সময় তেমন নেই। রামলীলার সভা বিজেপি বিরোধী ভোটারদের মনে বল যোগাবে ঠিকই, কিন্তু ভোটের ফলে খুব একটা হেরফের ঘটাতে পারবে না।"

দুর্নীতি যখন ইস্যু

বিজেপি বারবার বিরোধী জোটের মধ্যে থাকা দ্বন্দ্বকে তুলে ধরে কটাক্ষ করছে। রবিবার রামলীলার সভার পর উত্তরপ্রদেশের মিরাটে কর্মসূচি ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। সেখানে তিনি বিরোধীদের দুর্নীতিগ্রস্ত বলে আক্রমণ করেছেন। তার বক্তব্য, "দুর্নীতিবাজরা একজোট হয়েছে এক ছাতার তলায়। যত বড়ই নেতা হোক না কেন, সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।"

যদিও বাস্তবে দেখা গিয়েছে, অভিযুক্ত অনেক নেতা শিবির বদলে বিজেপিতে যোগ দেয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্ত থমকে গিয়েছে। এনসিপি প্রধান শরদ পাওয়ারের ভাইপো অজিত কিংবা এই দলের আরেক নেতা প্রফুল্ল প্যাটেল তার বড় উদাহরণ। অসমের বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিল পদ্ম শিবির। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী সম্পর্কেও একই কথা বলা হয়।

দিল্লির আপ সরকারের মন্ত্রী আতিশী আজ সাংবাদিক বৈঠকে এমনই বিস্ফোরক অভিযোগ তুলেছেন। তার দাবি, বিজেপির পক্ষ থেকে তাকে যোগদানের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। নইলে গ্রেপ্তার করা হতে পারে।

ভোটের মুখে কংগ্রেসকে আয়কর দপ্তরের নোটিস, তাদের ব্যাংক একাউন্ট বন্ধ করে দেয়ার উদ্যোগ, বিরোধী নেতা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের তলব নিয়ে জাতীয় নির্বাচন কমিশনে দরবার করেছেন ইন্ডিয়া শিবিরের নেতৃত্ব।

নির্বাচনে প্রভাব

পর্যবেক্ষকদের একাংশ মনে করছেন, বিজেপির দুর্নীতিবিরোধী প্রচার খুব একটা ফলপ্রসূ হবে না। বরং কেন্দ্রীয় সংস্থার দুমুখো আচরণ তাদের তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, "কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারি আপের পক্ষে সহানুভূতির হওয়া তুলে দিচ্ছে। সারা দেশেই এর প্রভাব পড়বে। এই নির্বাচনকে একটা বিষম জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্র, এমনটা মনে হচ্ছে। এখানে শাসক দল সব সুবিধা পাবে, কিন্তু বিরোধী নেতাদের জেলে ভরে দেয়া হবে।"

বিজেপি বিরোধীরা কতটা ভালো ফল করবে, তার অনেকটা নির্ভর করে কংগ্রেসের ফলাফলের উপর। প্রায় ২০০টি আসনে বিজেপি ও কংগ্রেসের মুখোমুখি লড়াই। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ আসনে গত লোকসভা ভোটে জিতেছিল বিজেপি। তাই ইন্ডিয়া শিবিরের সাফল্যের চাবিকাঠি রাহুল গান্ধীদের হাতেই রয়েছে।

গতবার গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, কর্নাটকের মতো বড় রাজ্যে বিজেপি একেবারে ধরাশায়ী করেছিল কংগ্রেসকে। রাহুলের ন্যায় যাত্রার পরও সাম্প্রতিককালের বিধানসভা ভোটে গোবলয়ে বিজেপি অপ্রত্যাশিত জয় পেয়েছে।

সেখানে কংগ্রেস কতটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারবে? শুভাশিস বলেন, "এসব রাজ্যে বিজেপির আসন কিছুটা কমতে পারে। তবে ২০০ আসনের মধ্যে কমবেশি দেড়শো কেন্দ্রে বিজেপি জিতবে বলেই আমার ধারণা। বাকি রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলির বিরুদ্ধে বিজেপির লড়াইটা কঠিন।"

বিরোধী শিবির গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষার কথা বলছে। মইদুলের মতে, তারা বিকল্প কী জনতাকে দিতে পারবে, সেটাও বলা দরকার। তিনি বলেন, "একটা অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি সামনে রাখা দরকার। তাহলে মানুষ বুঝতে পারবে, বিজেপি বিরোধী সরকার এলে তাদের কী সুবিধা হবে। শুধু কেন্দ্রের বিরোধিতা করে এক মঞ্চে এলে হবে না।"