জার্মানিতে পরমাণু শক্তি নিয়ে উভয় সংকট
পরমাণু শক্তিকে ঘিরে জার্মানিতে প্রবল উৎসাহের পর বিপদের আশঙ্কার মুখে শেষে জ্বালানির এই উৎস নিষিদ্ধ করা হয়৷ কিন্তু রাশিয়ার গ্যাসের বিকল্প হিসেবে আবার কিছুকালের জন্য পরমাণু বিদ্যুতের রমরমা দেখা যেতে পারে৷
জার্মানির প্রথম চুল্লি ‘পরমাণু ডিম’
১৯৫৭ সালের অক্টোবর মাসে জার্মানিতে প্রথম পরমাণু চুল্লি চালু হয়৷ মিউনিখের প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে আবার পরমাণু নিয়ে গবেষণার অংশ ছিল সেটি৷ ২০০০ সালে এই চুল্লি বন্ধ করে দেওয়া হয়৷
পরমাণু শক্তি বিরোধী আন্দোলনের সূচনা
১৯৭৩ সালে পেট্রোলিয়াম সংকটের ফলে পরমাণু শক্তির রমরমা বেড়ে যায়৷ কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে ‘নির্মল’ বলে পরিচিত এই জ্বালানি সম্পর্কে সংশয় বাড়তে থাকে৷ ফলে প্রতিরোধও জোরালো হয়৷ ১৯৭৬ সালে জার্মানির উত্তরে ব্রকডর্ফ পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সময় বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে প্রবল সংঘর্ষ দেখা যায়৷
হ্যারিসবার্গ ও চেরনোবিলের ঘটনায় বিহ্বলতা
পরমাণু শক্তি নিয়ে আশঙ্কা বাস্তব হয়ে ওঠায় বিহ্বলতা বেড়ে যায়৷ ১৯৭৯ সালের ২৮শে মার্চ অ্যামেরিকার হ্যারিসবার্গের কাছে থ্রি মাইল আইল্যান্ডে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বড় দুর্ঘটনা ঘটে৷ সাত বছর পর ইউক্রেনের চেরনোবিলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরমাণু বিপর্যয়ের সাক্ষী হয় মানুষ৷ তেজস্ক্রিয় মেঘ ইউরোপের আকাশ ছেয়ে যায়৷ পরমাণু শক্তির বিপদের প্রতিক হয়ে ওঠে চেরনোবিল৷
নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম
১৯৮০ সালে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে সবুজ দল প্রতিষ্ঠিত হয়৷ বামপন্থি, শান্তিকামী, পরিবেশবাদী ও পরমাণু শক্তির বিরোধীরা মিলে এই উদ্যোগ শুরু করেন৷ ১৯৮৩ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে জার্মান সংসদের নিম্ন কক্ষেও প্রবেশ করেন দলের অনেক প্রতিনিধি৷ পরমাণু শক্তির বিরোধিতা ছিল দলের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য৷
পরমাণু বর্জ্যের চূড়ান্ত গুদামের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ
পরমাণু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠে জার্মানির গোয়রলেবেন এলাকা৷ সেখানেই কয়েক দশকের পরমাণু বর্জ্য জমা রাখার পরিকল্পনা করা হয়৷ ১৯৯৫ সালের ২৪শে এপ্রিল প্রথমবার বর্জ্য পরিবহণের সময়ে বিক্ষোভকারীদের প্রবল প্রতিরোধ দেখা যায়৷ ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে শেষ বার সেখানে পরমাণু বর্জ্য পাঠানো হয়েছিল৷
ফুকুশিমার দুর্ঘটনার সুদূরপ্রসারী প্রভাব
২০১১ সালের ১১ই মার্চ জাপানের ফুকুশিমা পরমাণু কেন্দ্রে বিপর্যয় জার্মানিতেও পরমাণু শক্তি সম্পর্কে নীতি রাতারাতি বদলে দিয়েছিল৷ এমন বিপদের আশঙ্কা সম্পর্কে জাপানের তুলনায় আরও সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন জার্মানির নীতি নির্ধারকেরা৷
ম্যার্কেলের নেতৃত্বে জ্বালানি নীতির পরিবর্তন
ফুকুশিমা বিপর্যয়ের এক মাস পর তৎকালীন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল জ্বালানি নীতির ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন৷ সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২২ সালের শেষের মধ্যে জার্মানিতে সব পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাবার কথা৷ ২০১১ সালে জার্মান সংসদের নিম্ন কক্ষে সেই প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছিল৷
পরমাণু শক্তির অবসান
জার্মানির উত্তরে ব্রকডর্ফ পরমাণু কেন্দ্রে বহু বছর ধরে প্রবল প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখা গেছে৷ ২০২১ সালে সেটি অবশেষে বন্ধ করা হয়৷ ১৯৮৬ সাল থেকে সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে৷
আবার কি ফিরে আসবে পরমাণু বিদ্যুৎ?
২০২২ সালের ৩১শে ডিসেম্বর জার্মানিতে পরমাণু শক্তির অবসানের সিদ্ধান্ত আদৌ কার্যকর করা হবে কিনা,ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সে বিষয়ে সংশয় দেখা যাচ্ছে৷ এমনকি সবুজ দলের নেতা, ভাইস চ্যান্সেলর ও অর্থনীতি বিষয়ক মন্ত্রী রোব্যার্ট হাবেকও অবশিষ্ট তিনটি পরমাণু কেন্দ্র আরও কিছুকাল চালু রাখার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না৷ সবুজ দলের অংশগ্রহণে চালিত সরকারকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হলে সেটা হবে নিয়তির পরিহাস৷