1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

জলবায়ু পরিবর্তন তহবিলে কিছু কাজ পাওয়া, বাকিটা ‘হাওয়া’

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১১ নভেম্বর ২০২২

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় চলতি বাজেটে এক হাজার ৫০১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে৷ এই অর্থ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের জন্য৷ জাতীয় সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে এই ফান্ড গঠন করা হয়৷

https://p.dw.com/p/4JOzP
এবছর সুনামগঞ্জে বন্যা হয়েছে
ছবি: Mortaza Rashed/DW

কিন্তু এই ফান্ডের টাকা কতটা স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যবহার করা হয়? কতটা প্রকৃত কাজে লাগে?

গত ১৪ অক্টোবর জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের টাকা ঢালাওভাবে খরচ না করার সুপারিশ করে অনুমিত হিসাব সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি৷ পাশাপাশি এলাকার গুরুত্বভেদে আনুপাতিক হারে প্রকল্প নেয়ার সুপারিশও করে কমিটি৷

বৈঠকে জীববৈচিত্র রক্ষা, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করা হয়৷

এর আগে ২০১৮ সালেও প্রশ্ন তোলে সংসদীয় কমিটি৷ তারা জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প তেমন কোনো কাজে আসছে না বলে অভিযোগ করে৷

এদিকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের টাকায় পর্যটন কেন্দ্র, পার্ক, এমনকি পুকুরের পাশে বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণেরও ‘অভিযোগ’ আছে৷ আছে ইকোপার্কের নামে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন পার্ক নির্মাণেরও অভিযোগ৷

আবার উপকুলীয় সবুজ বেষ্টনি প্রকল্পে যে গাছ লাগানো হয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন আছে৷

প্রকল্প কী কাজে আসে

সাতক্ষীরার জলবায়ু পরিষদের আহ্বায়ক আশিক-ই-ইলাহী বলেন, ‘‘শ্যামনগর উপজেলার কাশিমারি ইউনিয়নের ঘোলা এলাকায় পানীয় জলের সমস্যা৷ লবণপানি সেখানে৷ সেখানকার একটি পুকুর, যেখানে সবাই গোসল করেন, থালাবাসন পরিষ্কার করেন, সেই পুকুরকে জলবায়ু ট্রাস্টের ফান্ডের টাকায় ঘিরে দিয়ে পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ এটা কি হয়? আবার ওই এলাকায় বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর স্থানীয় লোকজন নিজেদের উদ্যোগে বাঁধ নির্মাণ করেন৷ সেটা দেখিয়ে আবার একটি প্রজেক্ট পাস করা হয়েছে৷ এভাবে অপ্রয়োজনীয় প্রজেক্টের মাধ্যমে টাকার নয়ছয় করা হচ্ছে৷ আমরা একটি জরিপ করে এরকম আরো অনেক ঘটনা পেয়েছি৷’’

তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘ট্রাস্ট ফান্ডের প্রজেক্টের টাকার ৫০ ভাগ আগেই ঢাকায় খরচ হয়ে যায়৷ বাকি অর্ধেক যা আসে তা দিয়েও তেমন উপকারী কাজ হয় না, কারণ, মানুষের কী প্রয়োজন তা বিবেবচনা করা হয় না৷’’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে জলবায়ু তহবিল বরাদ্দ এবং এর গুণগত মান নিয়ে একটি গবেষণা প্রকাশ করে৷ তাতে বলা হয়, জলবায়ু তহবিল বরাদ্দে গুণগত মানের বদলে রাজনৈতিক প্রভাব বেশি কাজ করছে৷ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘স্থানীয় জলবায়ু বিপন্নতা ও বরাদ্দের মধ্যে অসামঞ্জস্যতার কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা আরো বেশি ঝুঁকিতে পড়ছে৷’’

প্রজেক্টের মাধ্যমে টাকার নয়ছয় করা হচ্ছে: আশিক-ই-ইলাহী

গবেষণার শিরোনাম ছিল ‘জলবায়ু অর্থায়ন ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান: প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসন’৷ তাতে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় স্থানীয় সরকারের ১০৮টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে৷ এর মধ্যে মহানগরে তিনটি, পৌরসভায় ৯১টি ও জেলা পরিষদে ১৪টি প্রকল্পে বাজেট প্রায় ৩৫৪ কোটি টাকা৷ বিপন্নতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তহবিল বরাদ্দ হচ্ছে না৷ রাজনৈতিক প্রভাব বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাচ্ছে৷ যেখানে ঝুঁকি বেশি, সেখানে বরাদ্দ কম, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কারণে ‘পছন্দমতো প্রকল্প' নিয়ে বরাদ্দ বেশি করায় ক্ষতিগ্রস্তরা বঞ্চিত হচ্ছে৷ এতে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় এসব প্রকল্পে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে৷ জনগণের সম্মতি ছাড়া নিজেদের মতো করে প্রকল্প নিলে তার সুফল পাওয়া যাবে না৷

গবেষণা জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রায় ৯২ শতাংশ উত্তরদাতা প্রকল্প সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি সম্পর্কে জানেন না; প্রকল্প এলাকায় তথ্যবোর্ড স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণে ত্রুটি এবং তথ্যবোর্ডে অপর্যাপ্ত তথ্য৷

৫০ ভাগ অর্থই পকেটে যায়

পরিবেশ বিজ্ঞানী ও জলবাযু বিশেষজ্ঞ ড. আতিক রহমান বলেন, ‘‘এখন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে৷ তারপরও বরাদ্দ অর্থের অর্ধেকের বেশি কাজ হয় না৷ এর ২০ ভাগ হয় অপচয়, ২০ ভাগ যায় যারা প্রকল্প পাস করেন তাদের পকেটে, ১০-১৫ ভাগ চলে যায় ঠিকাদারসহ অন্যান্যদের পকেটে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘আরো সমস্যা আছে৷ প্রকল্প গ্রহণে অভিজ্ঞ লোকের অভাব৷ প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা না করা৷ আর প্রকল্প অনুমোদনকারীদের প্রভাবের কারণে সঠিক প্রকল্প নেয়া যায় না৷ এরকম অনেক প্রয়োজনীয় প্রকল্প এখন কাজে আসছে না৷ তারপরও আগের চেয়ে কাজ ভালো হচ্ছে৷ বাংলাদেশে অন্তত ছয়জন বিজ্ঞানী আছেন যারা বিষয়টি বোঝেন৷’’

কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এবার যারা কপ সম্মেলনে মিশর গেছেন, তাদের পর্যাপ্ত দক্ষতা নেই বলেও মনে করেন ড. আতিক রহমান৷

২০ ভাগ যায় যারা প্রকল্প পাস করেন তাদের পকেটে: ড. আতিক রহমান

বাজেট

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সংরক্ষণে এক হাজার ৫০১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে৷ গত অর্থবছরে এই খাতে বাজেটের পরিমাণ ছিল এক হাজার ২২৪ কোটি টাকা৷ ২০১০ সালের পর থেকে এই খাতে বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ কম-বেশি এরকমই৷

এর বাইরে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি থেকে ৪৩টি প্রকল্পে ১৬ কোটি মার্কিন ডলার অনুদান পেয়েছে, গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড থেকে ৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার এবং ক্লাইমেট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড থেকে ১১ কোটি ডলার অর্থ পেয়েছে৷ এর বাইরে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উৎস থেকে ১০৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার অনুদান পেয়েছে৷ আর সর্বশেষ আইএমএফের ৪.৫ বিলিয়ন ঋণের ১.৩ বিলিয়ন দেয়া হয়েছে জলবায়ু খাতে৷

প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার এক কোটি ৩৩ লাখ মানুষ বাসস্থান হারাবেন৷ বিশ্বব্যাংকের হিসাব জানাচ্ছে, বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর চার লাখ মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছেন স্থায়ীভাবে৷প্রতিদিন আসছে দুই হাজারের মতো৷ তাদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ জলবায়ু উদ্বাস্তু৷

জলবায়ুর অনেক প্রকল্পই কাজে আসে না: ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

ড. আতিক রহমান বলেন, ‘‘বাইরের ক্লাইমেট ফান্ড থেকে তেমন অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না৷ তারা মুখে বলছে, কিন্তু কাজে তেমন কিছু করছে না৷ বাংলাদেশ নিজে থেকেই ফান্ড গঠন করে কাজ করছে৷ আমরা রোল মডেল হতে পারতাম৷ কিন্তু পর্যাপ্ত দক্ষতা আর স্বচ্ছতার অভাবে সেটা এখনো হয়নি৷ তারপরও বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় আমরা ভালো করছি৷ আমাদের ভালো করতে হবে, কারণ, আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে৷’’

সিপিডির গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘অনেক সময় অর্থ খরচ করার জন্য প্রকল্পগুলো নেয়া হয়৷ প্রকল্প নেয়ার আগে তার সম্ভাব্যতা যাচাই, স্থানীয় লোকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা দরকার৷ এগুলো না করায় জলবায়ুর অনেক প্রকল্পই কাজে আসে না৷ অডিট হয় না৷ সিলেকশন প্রসেস নিয়ে প্রশ্ন আছে৷ এখানে ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থের অপচয় হচ্ছে৷’’

‘‘আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি নিয়ে আমাদের প্রতি সংবেদনশীল আছে৷ কিন্তু তাদের ফান্ড পেতে হলে আমাদের সঠিকভাবে প্রকল্প নিতে হবে৷ গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে,’’ বললেন এই অর্থনীতিবিদ৷