জঙ্গি ছিনতাইয়ের পর বদলে যাওয়া আদালতপাড়া
২০ নভেম্বর ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সামনে থেকে দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার পর আদালত চত্বরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে৷ আদালতপাড়ার হঠাৎ বদলে যাওয়ার চিত্র দেখুন ছবিঘরে....
৯ বছর পর আবার
২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনার ৯ বছর পর গত ২০ নভেম্বর ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রধান ফটকের সামনে থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম (সাবেক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম)-এর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ও মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামিরকে ছিনিয়ে নেয় তাদের সহযোগীরা৷
প্রধান ফটকে জিজ্ঞাসাবাদ
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের প্রধান ফটকের সামনে ব্যক্তিগত গাড়িতে করে আসা এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ৷ এছাড়া কারো গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হলে আদালতপাড়ায় আসার কারণসহ বিস্তারিত জানতে চাওয়া হচ্ছে৷
পাহারায় পুলিশ
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং মহানগর দায়রা জজ আদালতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কিছু দূর পরপর পুলিশের ৩-৪ জনের একটি দল পাহারা দিচ্ছে৷ কবে থেকে এখানে দায়িত্ব পালন করছেন জানতে চাইলে তারা জানান, ২০ তারিখের পর থেকে নিয়মিত তারা এখানে দায়িত্ব পালন করছেন৷
রেড অ্যালার্ট ও পুরস্কার ঘোষণা
প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন এবং লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনার পর বেনাপোল স্থলবন্দরসহ দেশজুড়ে ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি করা হয়েছে৷ তাদের ধরিয়ে দিলে পুরস্কার দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান৷ তিনি বলেন, দুই জঙ্গিকে ধরতে ১০ লাখ টাকা করে মোট ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে৷
আড্ডায় আলোচনার বিষয়বস্তু জঙ্গি ছিনতাই
সিএমএম আদালতের আশেপাশে চায়ের দোকানে গিয়ে দেখা যায় সেখানে মানুষ জঙ্গি ছিনতাই নিয়ে আলোচনা করছেন৷ ব্যবসায়ী রহমত আলী বলেন, ‘‘শুনেছি পুরো সিনেমার স্টাইলে এখান থেকে জঙ্গি নিয়ে গেছে৷ এর আগেও এখানে আসছি, তবে এত পুলিশ আগে দেখিনি৷’’
পুলিশের সংখ্যা এবং নজরদারি বৃদ্ধি
সিএমএম আদালতপ্রাঙ্গণে প্রধান ফটকে সকাল থেকেই পুলিশের কড়াকড়ি দেখা যায়৷ বুধবার সকাল ১০টা বাজতেই সেখানে অবস্থান নেন ১২-১৩ জনের দুটি নিরাপত্তা দল৷ এছাড়া সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারিও ছিল চোখে পড়ার মতো৷
সব আসামির হাতে এখন হাতকড়া
আদালতে নিয়মিত আসা আইনজীবী, সাক্ষী এবং হাজতিদের পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনার আগে আসামিদের হাতকড়া বা দড়ির ব্যবহার খুব একটা না থাকলেও এখন প্রত্যেককে কড়া নিরাপত্তায় আদালতে আনা-নেওয়া হচ্ছে৷ এছাড়া আদালতপ্রাঙ্গণে আগে কখনো এত পুলিশ সদস্য দেখেননি বলেও জানান তারা৷
সব সাময়িক?
পুরান ঢাকার সিএমএম, সিজেএম কোর্ট এবং মহানগর দায়রা জজ আদালতে একাধিক ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী, আইনজীবী এবং সাধারণ মানুষের কাছে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা পুরো বিষয়টিকে ‘অবিশ্বাস্য’ বলে মন্তব্য করেন৷ বর্তমানে নেয়া কড়াকড়ি ব্যবস্থাকে ‘সাময়িক’ মনে করছেন তারা৷ আগামী কিছুদিনের মধ্যেই আরেকটি বড় ঘটনা ঘটলে এই ঘটনা ধামাচাপা পড়ে পরিস্থিতি আগের রূপেই ফিরে যাবে বলে বিশ্বাস তাদের৷
অস্থায়ী হাজতখানায় এখনো শৈথিল্য!
সিএমএম আদালতের পাশে অস্থায়ী হাজতখানায় বিভিন্ন মামলার আসামিদের জেলখানা থেকে এনে আদালতে হাজিরা দেওয়ানোর আগে কয়েক ঘণ্টার জন্য রাখা হয়৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ছাড়া সেখানে কারো প্রবেশের অনুমতি না থাকলেও বুধবার হাজতিদের আত্মীয়-স্বজনদের সেখানে প্রবেশ করতে দেখা গেছে৷ তবে সাংবাদিকের উপস্থিতি দেখে সেখানে বহিরাগতদের প্রবেশ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়৷
শুধু গরিবদের জন্য?
২০১৪ সাল থেকে রাজনৈতিক মামলায় সাত মাস জেল খেটেছেন ব্যবসায়ী মো. শামীম মোল্লা৷ তিনি মনে করেন, ‘‘এইসব আইন-কানুন আর কড়াকড়ি শুধু যাদের টাকা নাই, তাদের জন্য৷ এই যে পাশেই হাজতখানা, এখানে পাঁচশ-হাজার টাকার বিনিময়ে আত্মীয়-স্বজনেরা হাজতিদের খাবারদাবার থেকে শুরু করে ইয়াবা-ডাইলও হাতে দিতে পারে৷’’
অনেক অনিয়ম
ঢাকার নিম্ন আদালতের আইনজীবী মোঃ আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘‘দুর্ধর্ষ এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিদের এভাবে ডান্ডাবেড়ি ছাড়া শুধু হাতকড়া পরিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে একই পথে আদালতে নেওয়া হবে কেন? জঙ্গিদের নিরাপত্তায় পুলিশের সংখ্যাও ছিল অপর্যাপ্ত৷’’
বঙ্গবন্ধু চত্বর দোকানপাটমুক্ত
পুরান ঢাকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সংলগ্ন জেলা ও দায়রা জজ আদালত প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু চত্বরের চায়ের ১০-১২টি দোকান, ফলমূল বিক্রির ভ্রাম্যমাণ দোকান, ঝালমুড়ি-বাদাম বিক্রির দোকানসহ প্রায় ৩০টি দোকান তুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়৷ এছাড়া আরো দুইটি আদালত প্রাঙ্গণও জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনার পর থেকে ভ্রাম্যমাণ দোকানমুক্ত করা হয়েছে৷
পুলিশ বরখাস্ত
জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় পাঁচ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে৷ সাময়িক বরখাস্তরা হলেন- সিএমএম হাজতখানার কোর্ট ইন্সপেক্টর মতিউর রহমান, হাজতখানার ইনচার্জ এসআই নাহিদুর রহমান, আসামিদের আদালতে নেওয়ার দায়িত্বে থাকা পুলিশের এটিএসআই মহিউদ্দিন, কনস্টেবল শরিফুল হাসান ও কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার৷
নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে উচ্চ আদালতেও
ঢাকার নিম্ন আদালতে নিরাপত্তা বাড়ানোর পাশাপাশি উচ্চ আদালত তথা সুপ্রিম কোর্টেও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন৷ পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি নিরাপত্তা গেট বা আর্চওয়ে দিয়ে সবাইকে তল্লাশি করার পর বিভিন্ন ভবনে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে৷
শুধু সাইনবোর্ডেই সীমাবদ্ধ
সিএমএম আদালত ভবনের দ্বিতীয় তলায় দেখা যায় জিআর শাখার প্রধান ফটকে ‘প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত’ সাইনবোর্ড ঝুলানো৷ তবে সেখানে সাধারণ মানুষের অবাধ যাতায়াত দেখা যায়৷ এমনকি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কোনো নিরাপত্তারক্ষীকে ফটকে দেখা যায়নি৷
আদালতে স্বজনদের সাক্ষাত
ঢাকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সংলগ্ন মহানগর দায়রা জজ আদালতের দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে পুলিশ প্রহরায় হাজিরা দিতে আসা হাতকড়া পরা আসামিদের সাথে তাদের পরিবারের সদস্যরা কথা বলছেন, খাবারদাবার, পরনের কাপড়চোপড় দিচ্ছেন এবং সন্তানকেও কোলে দিচ্ছেন৷ তবে এসব কাজ সম্পূর্ণ অবৈধ বলে জানান নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা৷