‘জঙ্গিদের বিষয়ে সচেতন না হলে ভবিষ্যতে আরো ভুগতে হতে পারে’
২৫ নভেম্বর ২০২২এর উত্তর খোঁজা হয়েছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার তৌহিদুল ইসলামের সঙ্গে৷
ডয়চে ভেলে : আপনি তো জঙ্গিবিরোধী অনেকগুলো বড় অভিযানে অংশ নিয়েছেন৷ এসব অভিযানে গিয়ে কী ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে?
তৌহিদুল ইসলাম : এই অভিযানগুলো অত্যন্ত রিস্কি৷ মূলত হোলি আর্টিজানের ঘটনার পর আমরা জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা পাই৷ এর আগে থেকেই জানতাম, তবে ওই সময় পুরোপুরি ধারণাটা পাই৷ ওই সময় আমরা দেখেছি, নব্য জেএমবি সারাদেশকে চারভাগে ভাগ করে চারটি ল্যাব প্রতিষ্ঠা করেছিল৷ একটা সিলেটে, একটা চট্টগ্রামের পটিয়ায়, একটা ঝিনাইদহে এবং আরেকটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ৷ এগুলো খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল৷ পটিয়াতে তো অপারেশনে আমাদের সোয়াতের ৯ জন আহত হয়েছিলেন৷ তাদের একজন তো এখনো পুরোপুরি সুস্থ না৷ প্রতিটি আস্তানায় তাদের অস্ত্র, গোলাবারুদ থাকতো৷ তাদের খুঁজে পাওয়াটাও ছিল চ্যালেঞ্জ৷ তারা সিকিউরিটি ব্যাপকভাবে মেনটেন করতো৷
যখন আস্তানায় সরাসরি অপারেশনে ঢুকে গেছেন, সেখানে কী ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েছেন?
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট- সিটিটিসি প্রতিষ্ঠার পর ২৩টি হাইরিস্ক অপারেশন হয়েছে৷ এই অপারেশনগুলো করেছে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সোয়াত৷ তবে তথ্য উপাত্তে যদি আমরা দেখতাম হাইরিস্ক নেই, সেখানে আমরা অপারেশন করতাম৷ আমি গাজীপুরের একটি অপারেশনের কথা বলি৷ আমরা একজনকে ধরলাম৷ তার কাছ থেকে তথ্য পেলাম, সে সকালে বের হয়েছে, যদি দুপুর ২টার মধ্যে বাসায় না ফেরে, তাহলে সঙ্গীরা ধরে নেবে সে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে৷ সেখানে গুরুত্বপূর্ণ একজন জঙ্গি ছিল৷ সময় মিস করলে তারা সেখান থেকে চলে যাবে৷ সেই পরিস্থিতিতে আমরা সোয়াতের সহযোগিতা নিতে পারিনি৷ এমনকি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটও নিতে পারিনি৷ হাতে সময় ছিল খুব কম৷ সেই পরিস্থিতিতে আমরা অপারেশনে যাই৷ একজন সামনে থেকে দরজা নক করবে, খোলার পর এক মিনিটিও সময় তাদের দেওয়া যাবে না৷ পরে আমরা দেখেছি, যে দরজা খুলেছে তার হাতের কাছে ৪টি চাপাতি, বোমা ও লোডেড একাধিক অস্ত্র ছিল৷ ফলে সে একমিনিট না ঘোরার সময় পেলেও আমরা কেউ ফিরে আসতে পারতাম না৷ এমন ঝুঁকি নিয়েও অপারেশন করতে হয়েছে৷ এমন পরিস্থিতিতে উপস্থিত বুদ্ধিটা কাজে লাগানো জরুরি হয়ে যায়৷
জঙ্গিরা যে অস্ত্র, গোলাবারুদ সংগ্রহ করতো, সেই চ্যানেল কি বন্ধ করা গেছে?
এগুলো তারা ব্ল্যাক মার্কেট থেকে সংগ্রহ করতো৷ এটা কখনোই বন্ধ হবে না৷ বর্ডার সিকিউরিটিকে আরো শক্তিশালী করতে হবে৷ এখনো তারা আর্মস সংগ্রহ করছে, মাদক সংগ্রহ করছে৷ এটা আসলে বন্ধ করা সম্ভবও না৷ তবে আমরা সতর্ক আছি৷ বর্ডার গার্ডকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে৷ যে যার জায়গা থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি তাদের নিবৃত্ত করার জন্য৷
হোলিআর্টিজানের পর আপনারা অনেকগুলো বড় অপারেশন করেছেন৷ এখন অনেকদিন কোনো বড় অপারেশন নেই৷ তারপর এই ঘটনা ঘটে গেল৷ তাহলে কি আপনারা ওদের তৎপরতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না?
তখন আইএসের মতাদর্শে নব্য জেএমবি সংগঠিত হচ্ছিল৷ আমরা ২০১২-১৩ সাল থেকেই তাদের ব্যাপারে তথ্যগুলো পাচ্ছিলাম৷ সেই সূত্র ধরেই সিটিটিসি প্রতিষ্ঠা হয়৷ তখনই আমরা বুঝতেছিলাম সামনে ভয়ঙ্কর সময় আসছে৷ ওই সময় আমাদের অপারেশনে ৭৮ জন জঙ্গি হয় নিজেদের বোমায় নিজেরা উড়িয়ে দিয়েছে, অথবা সোয়াতের অপারেশনে মারা গেছে৷ নব্য জেএমবির ক্ষেত্রে ওই সময় যারা দায়িত্বে ছিল, তাদের নেটওয়ার্ক কিন্তু ভেঙে গিয়েছিল৷ আর আনসার আল ইসলাম ২০১৩ সাল থেকে ব্লগার এবং মুক্তমনা লেখকদের উপর ১৭টি আক্রমন করেছে৷ তখন তাদের সামরিক টিমের যে ১৭-১৮ জন ছিল, তাদের মধ্যে ১০-১২ জনকে আমরা ধরে ফেলেছিলাম৷ তখন তাদের শক্তি অনেকটাই কমে গিয়েছিল৷ সিটিটিসি সাড়ে ৫শ' জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছে৷
আপনারা ধরতে পারেননি, কিন্তু তথ্য আছে এমন জঙ্গিদের সংখ্যা কেমন হবে?
এটা বলা মুশকিল৷ একেকজনকে গ্রেফতারের পর কিছু তথ্য পাওয়া যায়৷ আমরাও কিছু তথ্য পাই৷ এখন চারটি সংগঠন সক্রিয়৷ এর মধ্যে নব্য জেএমবি, আনসার আল ইসলাম, হুজি এবং হিযবুত তাহরীর৷ এর মধ্যে হিযবুত তাহরীর এখনও কোনো অপারেশনে যায়নি৷ তারা মানুষকে মোবিলাইজ করছে৷ এই সংগঠনগুলোর আইডোলোজিক্যাল মিল আছে৷ অপারেশনাল কিছু পার্থক্য থাকলে উদ্দেশ্য একই৷
ত্রিশাল থেকে যে তিনজনকে জঙ্গিরা ছিনিয়ে নিয়েছিল, তাদের সবাই কি ধরা পড়েছে?
সালাহউদ্দিন সালেহীন এখনও বাইরে আছে৷ সে পুরোনো জেএমবির নেতৃত্ব দেয়৷ অনেকবার কাছাকাছি গিয়েও তাকে ধরতে পারিনি৷ ভারতে কিছুদিন ছিল৷ যখন বোমা মিজান ভারতে ধরা পড়ে, তখন সে ব্যাঙ্গালুরুতে ছিল৷ সেখানকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অল্পের জন্য তাকে ধরতে পারেনি৷ আমরা অল্পের জন্য তাকে ধরতে পারিনি৷ সে কখনও দেশে, কখনও বিদেশে অবস্থান করে অত্যন্ত সিকিউরিটি নিয়ে৷ প্রযুক্তির কারণে তারা এমন কিছু অ্যাপ তৈরি করেছে যেগুলোর প্রবেশাধিকার আমাদের কাছে নেই৷ ফলে আমাদের কাজের ধরনও টাফ হয়ে যাচ্ছে৷
মেজর জিয়া এখন কোথায়?
আমরা তো তাকে নিয়ে অনেকদিন ধরেই কাজ করছি৷ দেশের বাইরে থেকে যে ধরনের কাজ করা যায়, তার কার্যক্রমে আমাদের মনে হচ্ছে না সে দেশের বাইরে আছে৷ আমরা ধারণা করছি, সে দেশেই আছে৷
ত্রিশালের পর আদালত চত্তরে যেটা ঘটে গেল তাতে কি মনে হচ্ছে জঙ্গিদের হ্যান্ডেল করতে আমরা বেশি ঢিলেমি করেছি?
এই বিশ্লেষণ জরুরি৷ ঢিলেমি করেছি কিনা সেটা তদন্ত করতে একাধিক কমিটি হয়েছে৷ তবে ত্রিশালের পর গাজীপুরে মুফতি হান্নানকেও ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল৷ সেটা কিন্তু তারা পারেনি৷ কিছু লুপহোলস তো ছিলই৷ তা না হলে এখান থেকে তো নিয়ে যেতে পারতো না৷ এ নিয়ে কাজ হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর না ঘটে সেই চেষ্টা করা হচ্ছে৷
এখন তাদের সামর্থ্য কোন পর্যায়ে?
কিছুদিন আগে আনসার আল সার্কিয়া নামে একটি সংগঠন সবাইকে এক প্ল্যাটফরমে নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছিল৷ তারা কিন্তু কুকিদের কাছ থেকে ট্রেনিং নিচ্ছিল৷ তার অর্থ তারা বসে নেই৷ শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করছে৷ তারা যাদের টেনিংয়ে নিয়ে গিয়েছিল তাদের আমরা সনাক্ত করেছি৷ বান্দরবানের সেই আস্তানাও আমরা শনাক্ত করে কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছি৷ তারা যাতে নেটওয়ার বিস্তার করতে না পারে, সে চেষ্টা আমরা সর্বদাই করে যাচ্ছি৷
প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে৷ সর্বশেষ আদালতের ঘটনায় যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি এক সময় সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন৷ এখন এই প্রবণতা কমেছে, নাকি বেড়েছে?
আমাদের সচেতনতার জায়গা বাড়াতে হবে৷ শুধু অভিযান দিয়ে হবে না৷ সিটিটিসি সেই জায়গা থেকে ৪৮ জেলায় কাজ করেছে৷ জঙ্গিবাদী তথ্য এখন অনলাইনে পাওয়া যায়৷ টেকনোলজির কারণে সব তথ্য আমরা আটকাতে পারি না৷ জঙ্গিরা কিন্তু তাদের স্ট্র্যাটেজি থেকে সরে এসেছে৷ আগে ছিল মাদ্রাসা কেন্দ্রিক, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে৷ আমরা গ্রেফতারকৃত ৩০০ জন জঙ্গিকে নিয়ে গবেষণা করে দেখেছি, এর ৪৬ শতাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র৷ তাদের রিক্রুটমেন্ট পলিসি থেকে সরে এসেছে৷ হোলিআর্টিজানে আমরা দেখেছি সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেরা এই অপারেশনে গেছে৷ হিযবুত তাহরীরের সরাসরি রিক্রুট পলিসিতেই আছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সেনাবাহিনী থেকে রিক্রুট করা৷ আনসার আল ইসলামও এই পলিসি নিয়েছে৷ এমনকি বিচারালয়েও রিক্রুট করতে তারা চেষ্টা করছে৷ আমরা সচেতন না হলে ভবিষ্যতে আরো ভুগতে হতে পারে৷