ছয় ছাত্র হত্যা মামলা : রায়ে স্বস্তি, দীর্ঘসূত্রতায় আক্ষেপ
২ ডিসেম্বর ২০২১২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবেবরাতের রাতে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে৷ বৃহস্পতিবার মামলার রায়ে১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৯ জনকে যাবজ্জীবন আর ২৫ জনকে খালাস দেয়া হয়৷
নিহত ছাত্র ইব্রাহীম খলিলের বাবা আবু তাহের ডয়চে ভেলের কাছে এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও আক্ষেপ করে বলেন, ‘‘বিচারে দীর্ঘ সময় লাগায় আমার পরিবারের সদস্যরা বিপর্যস্ত৷ ইব্রাহীমের মা বিচার দেখে যেতে পারেননি৷ তিনি তিন বছর আগে মারা গেছেন৷ এখনো তো আরো অনেক বাকি৷ আপিল আদালতে আরো কত সময় লাগে সর্বশেষ রায় পেতে তা-ও জানি না৷'' তার কথা, ‘‘তারপরও যদি দ্রুত এই রায় কার্যকর হয় তাহলে আমরা খুশি হবো৷''
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী শাকিলা জিয়াছমিন মিতু বলেন, ‘‘মামলা নিম্পত্তিতে দেরি হওয়ার প্রধান কারণ আদালতে মামলা চলাকালে বিভিন্ন পর্যায়ে তিনজন আসামির মৃত্যু হওয়া৷ আসামির মৃত্যু হওয়ার পর তা আদালতকে জানানোর দায়িত্ব আসামি পক্ষের আইনজীবীর৷ এরপর আদালত তা ভেরিফাই করেন৷ আসামিপক্ষ একদিকে যেমন জানাতে দেরি করেছেন, অন্যদিকে আদালতের যে কর্মচারীদের এটা ভেরিফাই করার দায়িত্ব, তারাও দেরি করেছেন৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘ তাছাড়া সাক্ষীদের আদালতে সঠিক সময় হাজির করা হয়নি৷ অনেক সময়ই সাক্ষীরা গরহাজির ছিলেন৷ ফলে সাক্ষ্য গ্রহণে অনেক সময় লেগে যায়৷ আর জেলে আটক থাকার পরও কিছু আসামিকে সময় সময় আদালতে হাজির করা হয়নি৷ আসামি আটক থাকার পরও আদালতে হাজির করা না হলে বিচারকাজ চলতে পারে না৷ তাতেও দেরি হয়েছে৷ এখানে কারা কর্তৃপক্ষ এবং কোর্ট পুলিশের দায় আছে৷ করোনার কারণেও আদালত বন্ধ ছিল৷''
তিনি বলেন, ‘‘তারপরও আমরা ন্যায় বিচার পেয়েছি৷ আশা করি উচ্চ আদালতেও এই রায় বহাল থাকবে৷''
তবে আসামি পক্ষের আইনজীবী শিউলি আক্তার দাবি করেন, মামলার বিচারে দীর্ঘ সময় লাগার জন্য তারা কোনোভাবেই দায়ী নন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা মনে করি, আমরা ন্যায় বিচার পাইনি৷ আমরা উচ্চ আদলতে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবো৷''
এই মামলায় ৯২ জন সাক্ষীর মধ্যে ৫৫ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে৷ আসামি ছিল ৬০ জন৷
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘‘মামলার বিচারে এই দীর্ঘ সময় লাগার অনেক কারণ আছে৷ এরমধ্যে বিচারকের সংকটই প্রধান৷ এছাড়া তদন্তে দেরি করা, সাক্ষী হাজির না হওয়া আর আইনের প্যাঁচে মামলার বিচার দেরি করার প্রবণতাও আছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘চাঞ্চচল্যকর মামলার বিচারে দ্রুত বিচার আদালতের ব্যবস্থা আছে৷ কিন্তু সেটা আদালতের হাতে নয়৷ সেটা সরকারের হাতে৷ আদালত চাইলেই কোনো মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠাতে পারেন না৷ এটার সিদ্ধান্ত নেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ তারাই কোন মামলা চাঞ্চল্যকর বিবেচনা করা হবে সেই সিদ্ধান্ত নেন৷এই মামলাটিও সেই বিবেচনা পেতে পারতো৷''
তবে এ ধরনের মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে অন্তর্ভুক্ত করা বিষয়ে তার শঙ্কা, ‘‘এতে হয়ত কোনো কোনো মামলার দ্রুত বিচার হবে, কিন্তু মূল সমস্যার সমাধান হবে না৷ কারণ, সব মামলা তো আর দ্রুত করা যাবে না৷ সেই জনবল ও বিচারিক অবকাঠামো নেই৷''
গত জুন মাসের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ২৯ লাখ ৩৩ হাজার৷ বিচারাধীন মামলার মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট মিলিয়ে প্রায় ৭০ হাজার মামলা আছে৷ বাকি মামলাগুলো বিচারিক আদালতে৷
বাংলাদেশে এখন ১৭ কোটি মানুষের বিপরীতে বিচারকের সংখ্যা এক হাজার ৮০০ জন৷ মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘‘শুধু বিচারক বাড়ালে হবে না৷ এরসঙ্গে দক্ষ আইন কর্মকর্তা, দক্ষ তদন্ত কর্মকর্তা ও অবকাঠামোও বাড়াতে হবে৷''
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সাবেব বিচারক আজিজুর রহমান দুলু বলেন, ‘‘বিচারকদের মামলার বিচারের চেয়ে জামিন নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়৷ তারা যে কাজ করেন, তার ৭০ ভাগই জামিন সংক্রান্ত৷ এই জামিনের বিষয়টি নিয়ে ভাবা প্রয়োজন৷ কারণ, জামিন দেয়ার ক্ষমতা পুলিশেরও আছে৷ আর সব মামলায় আসামি গ্রেপ্তারেরও প্রয়োজন নেই৷ এটা বিবেচনায় নিলে বিচারকরা বিচারকাজে বেশি মনযোগী হতে পারবেন৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘প্রতিটি হত্যা মামলারই গুরুত্ব সমান৷ তাই বিশেষ কোনো মামলাকে চাঞ্চল্যকর বিবেচনা করে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠালে সেটাও ন্যায়বিচার পরিপন্থি, কারণ, একটি মামলার বিচার দ্রুত হবে, আরেকটির হবে না৷ সেটা তো হতে পারে না৷ তাই সার্বিক ব্যবস্থাই দ্রুত করা প্রয়োজন৷''