চায়ের ছাঁকনি থেকে পানীয় জলের ফিল্টার
১৯ নভেম্বর ২০১০আশ্চর্য চায়ের ছাঁকনি
বড় আকারে উৎপাদন শুরু হওয়ার আগে মারেলিজে বুটস শেষবারের মত কিছু পরীক্ষা সেরে ফেলছেন৷ স্টেলেনবশ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই মাইক্রো-বায়োলজিস্ট আধ বোতল জল ঢালছেন ছোট চায়ের ছাঁকনির মত দেখতে এক ফিল্টারে৷ এই জল পরীক্ষা করে দেখা হবে, তা কতটা বিশুদ্ধ৷ মাত্র ৩০ বর্গ মিটার আকারের এই গবেষণাগারে তৈরি হয়েছে এই অভিনব ফিল্টার৷ বুটস জানালেন, ‘‘এই ছাঁকনি অত্যন্ত শস্তা৷ এমনকি মিনারেল ওয়াটারের বোতল বা বাজারে প্রচলিত ফিল্টারের চেয়েও এর দাম কম৷ ব্যবহারের পদ্ধতিও অত্যন্ত সহজ৷ ফলে প্রত্যন্ত এলাকায়ও এই ফিল্টার বিতরণ করা যেতে পেরে৷ শুধু তাই নয়, এই ছাঁকনি দুষিত জল থেকে জীবাণু আলাদা করে আস্তে আস্তে জীবাণু নষ্ট করে দেয়৷ ফলে সেই জীবাণু আবার নতুন করে ছড়িয়ে পড়তে পারে না৷''
আবিষ্কারের রহস্য
জাতিসংঘ সহ অসংখ্য এনজিও এই সাফল্যের কথা জানতে পেরে স্টেলেনবশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে৷ এই আশ্চর্য ফিল্টার নিয়ে সবার মনেই আগ্রহ দেখা দিয়েছে৷ এতে বিস্ময়ের কোনো কারণ নেই, কারণ শুধু আফ্রিকা মহাদেশেই প্রায় ৩০ কোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানীয় জল পায় না৷ অন্য অনেক আবিষ্কারের মতো এই ফিল্টারের ধারণাও এক কাকতালীয় ঘটনা৷ অধ্যাপক ইউজিন ক্লুটি জানালেন, ‘‘শুরু থেকে আমাদের গবেষণার দিশা মোটেই ঠিক এই দিকে ছিলো না৷ আমরা আসলে শিল্পক্ষেত্রে কাজে লাগে, এমন বড় আকারের ফিল্টার তৈরি করতে চাইছিলাম৷ কিন্তু গবেষণাগারে কাজ করলে ছোট আকারে কাজ শুরু করতে হয়৷ প্রথম প্রচেষ্টায় হাতেনাতে ফল পেয়ে ছোট আকারের ফিল্টার তৈরির কথা আমার মনে আসে৷''
তখন চায়ের ছাঁকনির আদলে ফিল্টার তৈরি করার আইডিয়া মনে ধরে৷ ছাঁকনিতে চায়ের পাতা না দিয়ে অ্যাক্টিভেটেড কার্বন ভরে দেওয়া হয়, যা জল থেকে ক্ষতিকারক পদার্থ আলাদা করতে পারে৷ এর মধ্যে অভিনব কিছু নেই৷ তবে যুগান্তকারী নতুন সংযোজন ছিল ফিল্টারের কাগজের উপর বায়োসাইড'এর প্রলেপ লাগানো৷ অতি ক্ষুদ্র ন্যানো তন্তুর স্তর থাকে এর মধ্যে৷ এর ফলে শুধু ছাঁকনির মাধ্যমে জীবাণু আলাদা করা নয়, তাদের ধ্বংস করে দেওয়াও সম্ভব৷ এই ফিল্টারের ব্যবহার সহজ করতে বিভিন্ন আকারের হোল্ডারের মধ্যে ছাঁকনি বসিয়ে দেওয়া যায়৷ ফলে প্রচলিত প্রায় যে কোনো রকমের প্লাস্টিক বোতলে লাগানো যেতে পারে এই ফিল্টার৷ অধ্যাপক ইউজিন ক্লুটি আরও বললেন, ‘‘অতি দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করতে আমরা এখানে ন্যানো প্রযুক্তি কাজে লাগাচ্ছি৷ আমরা তাদের জীবনযাত্রা বদলে দেবো৷ একবার ভেবে দেখুন, আমরা এই সব মানুষের মনে কতটা আশার সঞ্চার করতে পারি৷ এখন আর তাদের পরিবারের শিশুরা দুষিত জল খেয়ে আচমকা ডায়েরিয়ায় মারা যাবে না৷''
বৃহত্তর লক্ষ্য
কেপ টাউন শহরের কাছে স্টেলেনবশ বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ক্লুটি ও তাঁর টিমের সাফল্য নিয়ে গর্বিত৷ চায়ের ছাঁকনির মতো জলের ফিল্টার এক বিশাল সাফল্য, কোনো সন্দেহ নেই৷ কিন্তু এটা কোনো বিচ্ছিন্ন প্রয়াস নয়৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যতমুখী গবেষণার একটা সার্বিক পরিকল্পনার অংশ এই কাজ৷ প্রকল্পের নাম ‘হোপ' বা আশা৷ বর্ণবৈষম্যের যুগের কালিমা মুছে ফেলে স্টেলেনবশ বিশ্ববিদ্যালয় ভবিষ্যতে দেশ ও গোটা আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য কাজ করতে চায়৷ প্রকল্পের জনক ডেসমন্ড থমাস বললেন, ‘‘স্টেলেনবশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলি অ্যাপারথাইড জমানার অন্যায় ব্যবস্থারই অংশ ছিলো৷ আমরা সেই বাস্তব স্বীকার করে অতীতের ভুল শুধরে নিতে চাই৷''
আগামী বছরগুলিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য হল ‘সাইন্স ফর সোসাইটি' – বা সমাজের কাছে বিজ্ঞানের সুফল এনে দেওয়া৷ এত বড় মাপের লক্ষ্য পূরণ করা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একার পক্ষে সম্ভব নয়৷ তাই অধ্যাপক ও ছাত্রছাত্রীদের একটি দল শীঘ্রই দেশের বাইরে গিয়ে এক প্রচারাভিযান শুরু করছে৷ ‘হোপ' প্রকল্প সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আফ্রিকা, অ্যামেরিকা ও ইউরোপে সহযোগিতার সম্ভাবনারও খোঁজ করবেন তাঁরা৷
চায়ের ছাঁকনির মতো ফিল্টার বিতরণের কাজেরও দেরি নেই৷ আগামী বছরের শুরুতেই এনজিও'গুলি এই কাজ শুরু করতে চলেছে৷ এই সাফল্যের কারণে অধ্যাপক ক্লুটি অত্যন্ত সন্তুষ্ট৷ তিনি বললেন, ‘‘এটা সত্যি একটা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা৷ বিজ্ঞানী হিসেবে আমি আমার জ্ঞান, সৃজনশীলতা ও প্রযুক্তির ক্ষমতা এমনভাবে কাজে লাগাতে পারছি, যে তার ফলে বিশ্বে অনেক মানুষের জীবনযাত্রায় উন্নতি ঘটছে৷''
প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক