চলে গেলেন মৃণাল সেন
৩০ ডিসেম্বর ২০১৮১৯৫০, '৬০ এবং '৭০ দশকের বাংলা, তথা ভারতের নিউ ওয়েভ সিনেমার তিন প্রধান স্তম্ভ ছিলেন ওঁরা তিনজন৷ চলচ্চিত্র দর্শন এবং নন্দনতত্ত্বের ‘ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর'৷ সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক এবং মৃণাল সেন৷ ৩০ ডিসেম্বর মৃণাল সেনের প্রয়াণ সেই যুগের অবসান ঘটালো, যদিও শারীরিক অসুস্থতার কারণে দীর্ঘদিন ছবি তৈরি থেকে দূরে সরে ছিলেন৷ শেষ পর্যায়ে ছিলেন শয্যাশায়ী, স্মৃতিভ্রংশ হয়েছিল৷ পরিচিত লোকজনকেও চিনতে পারতেন না৷ কিন্তু তিনি আছেন, চলচ্চিত্রমোদী দর্শকের কাছে এটাই যেন ছিল এক সান্ত্বনা৷ ভারতে চলচ্চিত্রের সেরা সম্মান দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার এবং পদ্মভূষণ খেতাবে সম্মানিত হয়েছিলেন তিনি৷ দেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তরে বিশিষ্ট, শ্রদ্ধেয় এই চলচ্চিত্রকারের মৃত্যুতে শোকাহত সারা দেশ৷
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টুইট করে জানিয়েছেন, ‘‘অসাধারণ কিছু ছবি আমাদের উপহার দিয়েছেন বলে সারা দেশ শ্রী মৃণাল সেনের কাছে কৃতজ্ঞ৷ যে দক্ষতা এবং সংবেদনশীলতা নিয়ে তিনি ছবি বানিয়েছেন, তা প্রশংসনীয়৷ তাঁর ছবি প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে একইরকম আদৃত৷''
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি টুইট করেছেন, ‘‘মৃণাল সেনের প্রয়াণে শোকাহত৷ চলচ্চিত্র জগতের বিরাট ক্ষতি। তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা৷''
উল্লেখ্য, মৃণাল সেন তাঁর শেষ ইচ্ছায় জানিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর মৃতদেহে যেন কোনো ফুল না দেওয়া হয়৷ কোনো প্রকাশ্য স্থানে তাঁর দেহ যেন সাধারণের শোক জানানোর জন্য না রাখা হয়৷ সেই ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে তাঁর দেহ সংরক্ষিত থাকবে আগামী তিন দিন৷ তাঁর একমাত্র ছেলে, যিনি অ্যামেরিকার শিকাগো শহরে থাকেন, তিনি এসে পৌঁছলে মৃণাল সেনের শেষকৃত্য হবে৷
অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন তাঁর শোকজ্ঞাপক টুইটে স্মরণ করেছেন মৃণাল সেন পরিচালিত ভুবন সোম ছবিতে প্রথম ‘ভয়েস ওভার' দেওয়ার কথা৷
এই ভুবন সোম ছবিটির কথা বারবার উঠে আসছে মৃণাল সেনের স্মৃতিচারণে, যে ছবি দেশে এবং বিদেশে মৃণাল সেনকে বিশেষ খ্যাতি এনে দিয়েছিল৷ এই সময়ের পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রিয় ছবির কথা বলতে গিয়ে ভুবন সোম-এর কথাই বললেন, যে দৃশ্যে একজন রাশভারি বড়কর্তা ভুবন সোম পাখি মারার জন্য বন্দুক হাতে ওঁৎ পেতে আছেন এবং গ্রামের এক স্থানীয় মেয়ে সেই দেখে এমন খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে যে, উড়ে পালিয়ে যায় পাখির ঝাঁক৷ অনিকেত ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘মৃণাল সেন একজন আদ্যন্ত নাগরিক চলচ্চিত্রকার৷ ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বাকিদের থেকে তিনি নিজেকে একটা স্বতন্ত্র জায়গায় দাঁড় করাতে পেরেছিলেন, কারণ তিনি যাই দেখতেন, সেটা অত্যন্ত নাগরিক চোখ দিয়ে দেখতেন৷''
এছাড়াও অনিকেত বলেছেন মৃণাল সেনের রাজনৈতিক সচেতনতা এবং চলতি, ঘটমান রাজনীতি সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানানোর সাহসের কথা, যা তাঁর সমসাময়িক পরিচালকদের মধ্যে বেশ বিরল৷ অনিকেত বললেন, ‘‘সত্তর দশক, যে সময় সবাই নিজের দিকে তাকিয়ে প্রতীকি ছবি তৈরি করছেন, অন্তর্মুখী হয়ে যাচ্ছেন, দর্শনের ওপরে দাঁড়িয়ে পড়ছেন, সোজাসুজি, সরাসরি কথাবার্তা বন্ধ করে দিচ্ছেন, সেই সময় কিন্তু মৃণাল সেন, সরোজ দত্ত হত্যাকাণ্ডকেও এমনকি, পর্দায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন৷''
পরিচালক মৃণাল সেনের একটি বৈশিষ্ট্যের কথা জানিয়েছেন অনিরুদ্ধ ধর, যিনি ১৯৯১ সালে তৈরি ‘মহাপৃথিবী' ছবিতে মৃণাল সেনের সহকারী ছিলেন৷ পরিচালক মৃণাল সেন সম্পর্কে কোন কথাটি তাঁর প্রথম মনে আসে? অনিরুদ্ধ জানাচ্ছেন, ‘‘ইন্ডিসিপ্লিন৷ পরিচালক হিসেবে মৃণাল সেনের মতো ইনডিসিপ্লিন্ড পরিচালক আর পৃথিবীতে দুটি নেই৷ কোনো চিত্রনাট্য থাকে না, কোনো শট ডিভিশন থাকে না, যা করার, সব (শ্যুটিংয়ের) ফ্লোরে এসে করেন৷ এটাই হচ্ছে, আমার মনে হয়, আধুনিক একজন চলচ্চিত্রকারের বৈশিষ্ট্য৷''
শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা