ক্লিন ফিডের সাথে দরকার ক্লিন লাইসেন্স আর স্বাধীনতার নিশ্চয়তা
৮ অক্টোবর ২০২১সরকার এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে শক্ত অবস্থান নিয়েছে, মোবাইল কোর্টও পরিচালনা করছে৷ 'ভারতসহ বিদেশি চ্যানেলগুলো তাদের মূল কনটেন্টের সাথে কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারবে না' -- সরকারের এমন নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশী দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার বন্ধের ঘটনা এবারই প্রথম নয়৷ একই কারণে ২০১৯ সালের এপ্রিলে একদিনের জন্য চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার বন্ধ ছিল৷ এছাড়া ২০১২ সালে এবং ২০১৪ সালে ভারতীয় চ্যানেলগুলোর সম্প্রচারে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে রিট করা হয়েছিল এবং আদালত তা খারিজ করে দেন৷ মোটামুটিভাবে গত এক দশকে বাংলাদেশে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর সম্প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে বেশ কয়েক দফায় নানা ভাবে উদ্যোগ নেয়া হলেও কোনোভাবেই তা সফল হয়নি৷ এসব উদ্যোগের পেছনে তিনটি কারণ খুঁজে পাওয়া যায়: এক. ভারতীয় চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠানের আধেয় শুধু সাংস্কৃতিক আগ্রাসন তৈরি করছে না পাশাপাশি এগুলো সামাজিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ; দুই. ভারতে বাংলাদেশি চ্যানেলগুলো দেখা না গেলেও ভারতীয় চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে অবাধে দেখা যাচ্ছে; এবং তিন. ভারতীয় এসব জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলে বাংলাদেশি বিজ্ঞাপন চলে যাচ্ছে, বিশেষ করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের বিজ্ঞাপন খাতের একটি বড় অংশ এসব চ্যানেলকে দিচ্ছে৷ ফলশ্রুতিতে শুধু সরকার রাজস্বই হারাচ্ছে না. পাশাপাশি দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলোর আয়েও ভাটা পড়েছে৷ প্রথম দুটি কারণকে অবশ্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে তেমন গুরুত্ব কখনই দেয়া হয়নি৷ সবশেষ বাণিজ্যিক কারণের সাথে আইনগত বিধিনিষেধ যুক্ত হয়ে বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে৷
‘কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন, ২০০৬' এর ১৯ ধারার ১৩ উপধারায় বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য বিদেশি কোনো চ্যানেলের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে৷ অর্থাৎ এই আইনে বিদেশি চ্যানেলের ক্লিন ফিড বা বিজ্ঞাপনমুক্ত সম্প্রচারের বিধান রয়েছে৷ একটি আইনের একটি উপধারা বলবৎ করার জন্য ১৫ বছর দীর্ঘ ও লম্বা সময় হলেও আমাদের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় তাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রশংসা পাচ্ছে৷ বিশেষ করে বাংলাদেশে বেসরকারি টিভি মালিকদের সংগঠনের (অ্যাটকো) অনেকদিনের দাবি পূরণের উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়৷
অ্যাটকোর নেতাদের বক্তব্য থেকে এটা মনে হতে পারে, বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর যে অর্থনৈতিক দুর্দশা তার জন্য ভারতীয় চ্যানেলগুলোর জনপ্রিয়তা এবং দেশীয় বিজ্ঞাপন তাদের কাছে চলে যাওয়াই মূলত দায়ী৷ বাংলাদেশের সম্প্রচার মাধ্যম ও তার আধেয় এবং এর অর্থনৈতিক ও বাজার ব্যবস্থার ধরনের কথা মাথায় রেখে এটি বলা যায়, ক্লিন ফিড নিশ্চিত করে বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অবস্থার উন্নতি করা যাবে না৷ উপরন্তু বিশ্বব্যাপী এখন ক্লিন ফিডের বাধা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য টিভি চ্যানেলগুলো নতুন একটি পদ্ধতিতে অনুষ্ঠান নির্মাণ করছে৷ সেটি হলো, অনুষ্ঠানের মূল আধেয়ের অংশ হিসেবে বিজ্ঞাপনের পণ্যকে অন্তর্ভুক্ত করা৷ যেমন, কোন নাটকে নায়িকা বা কোন চরিত্রের রান্নার দৃশ্য আছে, সে দৃশ্যে রান্নার কোন সামগ্রী- যেমন তেল বা মসলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্র্যান্ডের সামগ্রী ব্যবহারের দৃশ্য দেখানো৷ এটি এখন এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যে, এটাকে মূল অংশ থেকে বাদ দেয়া যাবে না৷ ফলে পুঁথিগতভাবে ক্লিন ফিডের যে ধারণা সেটিকে পাশ কাটিয়ে অনুষ্ঠানের মধ্যেই বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে৷ আবার ইন্টারনেটের এই বহুমাত্রিকতার যুগে ক্লিন ফিড চালু করে নিম্নমানের ও একই ধরনের ৩০/৪০টি টিভি চ্যানেলের আর্থিক স্বচ্ছলতা আনার কথা ভাবা কিভাবে সম্ভব?
গত এক দশকে যখনই ভারতীয় টিভি চ্যানেল বন্ধের উদ্যোগের কথা বাংলাদেশে শোনা গেছে তখনই সমান্তরালে একটি বিষয় আলোচিত হয়েছে, সেটি হলো- ভারতীয় টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানগুলো কেন বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে এত জনপ্রিয়৷ বিষয়টি ঘুরিয়ে বলা যায়, কেন বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো দেখছে? বিষয়টি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে এখনও কোন দর্শককেন্দ্রিক গবেষণা কিংবা জাতীয়ভিত্তিক জরিপ হয়নি৷ আমাদের দেশে টিভি ইন্ডাস্ট্রির বিস্ফোরণ ঘটেছে দুই দশক হয়েছে৷ এতটা সময়ে আমরা সুনির্দিষ্টভাবে জানতে পারলাম না বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর দর্শক বিমুখতার মূল কারণগুলো কী কী৷ বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকগণ বিজ্ঞাপন বেহাত হয়ে যাওয়া নিয়ে যতটা হা-হুতাশ করছেন, ততটা প্রচেষ্টা যদি নিজেদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানার জন্য প্রয়োগ করতেন তাহলে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের এতটা অবনতি হতো না৷ রোগ নির্ণয় না করে ঔষধ প্রয়োগের ধরনকে হাতুড়ে চিকিৎসা বলা হয়৷ এ পদ্ধতিতে টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়ন ঘটাতে চাইলে এই শিল্পটির যন্ত্রণা বাড়বে বৈকি কমবে না৷
সাদামাটাভাবে বলা হয়, অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন প্রচার আর অনুষ্ঠানের নিম্নমানের কারণে দর্শকরা বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল দেখে না৷ বাংলাদেশে টেলিভিশনের সাথে সম্পৃক্ত কর্তাব্যক্তিরা প্রায়ই অভিযোগ করেন, বাংলাদেশে গণমাধ্যম বিজ্ঞাপন বাজার এমনিতেই ছোট, উপরন্তু এত টিভি চ্যানেল হওয়ায় বিজ্ঞাপনদাতাদের মর্জি মত বিজ্ঞাপন চালাতে হয়৷ গণমাধ্যম চলে দ্বৈত বাজার অর্থনীতির নীতিতে৷ অর্থাৎ এখানে পাঠক/দর্শক হলো আপনার পণ্য, সে পণ্য যতটা শক্তিশালী হবে গণমাধ্যমটির কদর বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে ততটাই বেশি হবে৷ এর অর্থ হলো জনপ্রিয়তা থাকলে বিজ্ঞাপন আসতে বাধ্য৷ বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলেগুলোর অনুষ্ঠান সম্পর্কে দর্শকদের পছন্দ-অপছন্দ জানানোর প্রাতিষ্ঠানিক কোন প্লাটফর্ম নেই৷ বেসরকারিভাবে দু-একটি বাণিজ্যিক সংস্থা পরিমাণগত জরিপ করে থাকে, যেটি দিয়ে টিআরপি নির্ধারণ করা হয়৷ কিন্তু এসব জরিপের মান এতটাই প্রশ্নবিদ্ধ যে, এগুলো দিয়ে মানসম্মত ও দর্শক চাহিদাভিত্তিক অনুষ্ঠান নির্মাণের গাইড লাইন পাওয়া সম্ভব নয়৷ ভারতীয় বাংলা টিভি চ্যানেলগুলোর সোপ অপেরাগুলো আহামরি কোন নাটক নির্মাণ করে না৷ ভারতীয় চ্যানেলগুলোর প্রত্যেকটির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে৷ কোন প্রোগ্রাম চ্যানেল হাসির নাটক দেখানোর সময় বোমা হামলার কিংবা প্রধানমন্ত্রীর ফিতা কাটার সংবাদের ব্রেকিং প্রচার করে না৷ আমাদের টিভি চ্যানেলের কর্তাব্যক্তিরা নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারেন না তাদের চ্যানেলের চরিত্রটি কী ধরনের হবে, কারণ তারা জানেনই না দর্শকরা কি চান আর দর্শকদের প্রতি কি তাদের প্রতিশ্রুতি৷ দর্শকদের কাছে সুনির্দিষ্ট কন্টেন্ট নিয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না হলে নিজস্ব দর্শকগোষ্ঠী গড়ে তোলা সম্ভব নয়৷ ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সোপ অপেরাগুলো জীবন ও নিজস্ব সংস্কৃতি ঘনিষ্ট করার চেষ্টা করা হয়৷ যেমন- তাদের প্রত্যেকটি সিরিয়ালে এমনকি রিয়ালিটি শো'তেও প্রত্যেক পূজা বা ধর্মীয় কিংবা জাতীয় দিবস ও আচার-অনুষ্ঠানকে আধেয় করা হয়৷ কিন্তু বাংলাদেশে ঈদ কিংবা পূজা অথবা জাতীয় দিবসগুলোতে টানা কয়েকদিনের অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়৷ পত্রিকার ঈদ সংখ্যা বের করার ধারণা দিয়ে টিভির আধেয় নির্মাণ করলে সেটিকে জনপ্রিয় করা সম্ভব নয়৷
ক্লিনফিড নতুন কোন ধারণা নয়৷ দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চালু আছে৷ যেমন সৌদি আরবে ভারতীয় টিভিচ্যানেলগুলোর আধেয় বিজ্ঞাপন ছাড়া প্রচারিত হয়৷ বাংলাদেশেও এ বিধানটি করা হয়েছে ১৫ বছর আগে৷ বাংলাদেশ সরকারের একাধিকবার সিদ্ধান্ত নিয়ে পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি প্রমাণ করে বেসরকারি টিভির প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি৷ বাংলাদেশের টিভি ইন্ডাস্ট্রির আজকের যে করুণ অবস্থা তার পেছনে দুটো বিষয় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে, এক. সরকারের রাজনৈতিক মতাদর্শিক বিবেচেনায় লাইসেন্সিং পদ্ধতি; দুই, রাজনৈতিক-ব্যবসায়িক সহ-মিলন মালিকানা৷ এই দুই নিয়ামকের শুরু বিএনপি আমলে আর এর ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে আওয়ামী লীগ আমলে৷ বাংলাদেশে সব সরকারের কাছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অর্থ হলো কোন সরকার কতগুলো রেডিও-টিভির অনুমোদন দিল৷ এ নিয়ে ৪৩টি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অনুমোদন দেয়া হয়েছে৷ আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে মোট ৩৩টি আর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ১০টি টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স দিয়েছিল৷ দুই দলের যেই সরকারে থাকুক না কেন বাংলাদেশে এমন কোন টিভি চ্যানেল নেই যেটির লাইসেন্স রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া হয়নি৷ এই চ্যানেলগুলোর মান কোন বিচার্য বিষয় নয়, বরং তাদের রাজনৈতিক আনুগত্যই সরকারগুলোর কাছে মুখ্য৷ অন্যদিকে রাজনীতি এবং ব্যবসায়ী বা কর্পোরেট গোষ্ঠীর সহ-মিলন মালিকানা পদ্ধতিতে পরিচালিত টিভি চ্যানেল কখনই দর্শকপ্রিয়তার কথা ভাবে না৷ তাদের মাথায় থাকে যেনতেনভাবে রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক স্বার্থের কথা৷ ফলশ্রুতিতে আমাদের টিভি চ্যানেলের কর্মীরা ন্যূনতম স্বাধীনতাটুকুও অনেক সময় পান না৷ এমন পরিস্থিতিতে দর্শক চাহিদা বুঝা কিংবা তার জন্য নিয়মিত গবেষণা করা, গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে ভবিষ্যত পরিকল্পনা করা অলীক স্বপ্ন ছাড়া আর কি হতে পারে৷ নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের টিভি চ্যানেল সুনির্দিষ্ট অনুষ্ঠান বা আধেয় দিয়ে জনপ্রিয়তার মাধ্যমে নির্দিষ্ট দর্শক গোষ্ঠী তৈরি করবে- এটিই টিভি ইন্ডাস্ট্রির অর্থনীতির একেবারেই মোদ্দাকথা৷ নির্দিষ্ট দর্শক গোষ্ঠী থাকলে বিজ্ঞাপনদাতা যত বড়ই হোক না কেন তাকে পণ্যের প্রচারে টিভি চ্যানেলের দ্বারস্থ হতেই হবে৷ বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় গণমাধ্যম যেহেতু টিভি, সেহেতু বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেলের জন্য এই কথাটি বেশি প্রযোজ্য৷