কেমন করে সোনা জিতলেন বাঙালি ভারোত্তোলক অচিন্ত্য?
১ আগস্ট ২০২২এই প্রথম এক বঙ্গসন্তান ভারোত্তোলক কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জিতলেন। সেটাও গেমস রেকর্ড করে। ফলে হাওড়ার পাঁচলার দেউলপুর গ্রামের এই যুবক ভারোত্তোলকের কৃতিত্ব কোনোভাবেই খাটো করে দেখা সম্ভব নয়। বিশেষ করে তিনি যখন কমনওয়েলথ গেমসে রেকর্ড করেছেন।
ভারোত্তোলনের ৭৩ কিলোগ্রাম বিভাগে অচিন্ত্য স্ন্যাচিংয়ে তুলেছেন ১৪৩ কিলোগ্রাম। ক্লিন ও জার্কে তিনি তোলেন ১৭০ কিলোগ্রাম। সবমিলিয়ে ৩১৩ কিলোগ্রাম, যা কমওয়েলথ গেমসের নতুন রেকর্ড।
সোনা জয়ের পর অচিন্ত্য বলেছেন, ''নিজের সঙ্গে লড়াই ছিল। আমি সোনা জিততে নয়, নিজেকে টপকে যেতে এসেছিলাম। সোনা জিতলেও নিজেকে টপকাতে পারিনি।'' অচিন্ত্য বলেছেন, ''এই সোনার পদক আমার দাদা ও কোচকে উৎসর্গ করেছি। দাদা আমার জন্য সবকিছু করেছে। আমাকে তৈরি করার জন্য নিজে ভারোত্তোলন ছেড়ে দিয়েছে।''
অচিন্ত্য শিউলির কাহিনি
দেউলপুর গ্রামে অচিন্ত্য শিউলির বাড়িতে এখনো মাটির দেওয়াল এবং টালির ছাদ। তার জেতা সোনার ও অন্য মেডেল রাখার কোনো আলমারি নেই। দেওয়ালে পেরেক পুঁতে তা রাখা আছে। তার মা জরির কাজ করেন। সপ্তাহে পাঁচশ টাকা পান। দাদা অলোক দমকল বিভাগের অস্থায়ী কর্মী। বাবা মারা গেছেন নয় বছর আগে। তিনি ভ্যান চালাতেন।
বাবা মারা যাওয়ার পর দুই ভাইও জরির কাজ করতেন। ২০১০ সালে ভারোত্তোলন শুরু করেন অলোক। এক বছর পর থেকে ভাইকেও তিনি সঙ্গে নেন।
বাবা মাত্র ৩৮ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। অচিন্ত্যর বয়স তখন মাত্র ১১ বছর। বাবার অন্ত্যেষ্টি করার খরচও তখন পরিবারের হাতে ছিল না। ধার করে সেই খরচ জোগাড় করেন অলোকরা। সেই সময় থেকেই ভারোত্তোলন অনুশীলন করতে শুরু করেন অচিন্ত্য। অষ্টম দাস হাতে ধরে সব শেখান।
কিন্তু তখন পুষ্টিকর খাবার জুটত না। একপ্লেট ঘুগনি ও একটা ডিমসেদ্ধ খেতে পারবে বলে অচিন্ত্য ধান বওয়ার কাজ করতেন। পরে যখন জাতীয় গেমসে গিয়ে সাতশ টাকা পেলেন, তখন সেটা তার কাছে বিশাল অর্থ মনে হয়েছিল।
২০১৩ সালে অলোক ও অচিন্ত্য জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। অচিন্ত্য সেখানে চতুর্থ হয়েছিলেন। পরে একটি প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জ পান। কোচ অষ্টম দাস তাকে নিয়ে যান সেনাবাহিনীর ট্রায়ালে। সেখানে অচিন্ত্য মনোনীত হন। এরপরই তিনি প্রশিক্ষণ, পুষ্টিকর খাবার পেতে থাকেন। ২০২৪ সালের অলিম্পিকে মেডেল পেতে পারেন এমন ক্রীড়াবিদদের তালিকায় অচিন্ত্যর নাম ওঠে ২০২০ সালে। তারপরই অচিন্ত্যর সামনে নতুন দিগন্ত খুলে যায়। তিনি প্রয়োজনীয় সব সুযোগ পান। তারই ফসল কমনওয়েলথ গেমসের সোনা।
অলোক এই সময়কে বলেছেন, তারা খুবই অভাব-অনটনের মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছেন। প্রথমে স্থানীয় প্রশিক্ষক অষ্টম দাসের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ২০১৪ সালে হরিয়ানার ন্যাশনাল গেমসে অচিন্ত্য ব্রোঞ্জ পান। তারপর সেনার স্পোর্টস ইনস্টিটিউট (সার্ভিসেস)-এ যোগ দেন তিনি।
কমনওয়েলথ গেমস শুরু হওয়ার একমাস আগেই যুক্তরাজ্যে পৌঁছে গেছিলেন অচিন্ত্য।
এখন সেনাবহিনীতে হাবিলদার হিসাবে কাজ করেন। সেখানেই তার প্রশিক্ষণ চলে। পড়াশুনোও করছেন।
চ্যাম্পিয়ন তৈরির কারিগর
অচিন্ত্যর কোচ অষ্টম দাস শেখাবার জন্য কোনো পয়সা নেন না। তিনিও খুব গরিব। কখনো কারখানায় কাজ করেন, কখনো চাষের কাজ। লকডাউনের সময় রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করেছেন। তিনি গাছের তলায় ভারোত্তোলন শেখান। বৃষ্টি হলে বন্ধ। ভারোত্তোলনের জিনিসে মরচে পড়ে গেছে। সেখানেই কোচিং করাচ্ছেন অষ্টম। চ্যাম্পিয়ন তৈরি করছেন। কিন্তু নিজের জীবন কাটে কষ্টে।
জিএইচ/এসজি (পিটিআই, এই সময়)