কারাগারের দশ চিত্র
কারাগার মানেই দুর্ভেদ্য প্রাচীর আর তার ভিতরে বন্দিজীবন। সে জীবনের গল্প খুব কমই প্রকাশ পায় বাইরে। তবুও কারাগারের ভিতরের অমানবিকতা, অনিয়মসহ বিভিন্ন ঘটনা নানা সময়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশে।
জেল হত্যা
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতা দখলকারীরা জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচ কামরুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক করে রাখে৷ ৩ রা নভেম্বর সেখানেই গুলি করে হত্যা করা হয় তাদের। বাংলাদেশে কারাগারের ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ও বিশ্বে বিরল এ ঘটনা।
হত্যা, না আত্মহত্যা?
২০১৯ সালে পঞ্চগড় জেলা কারাগারে পলাশ কুমার নামের এক আইনজীবীকে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে। হাসপাতালে মৃত্যুর আগে তিনি বলেছেন, ‘‘কারাগারের ভিতরে দু‘জন লোক তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়৷’’ যদিও পঞ্চগড়ের জেলার সেসময় দাবি করেন, বাথরুমে লাইটার দিয়ে পলাশ নিজেই শরীরে আগুন দিয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে কক্সবাজার জেলা কারাগারে এক হাজতির গলায় ফাঁস লাগানো লাশ পাওয়া যায়। সেটিও হত্যা, না আত্মহত্যা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে।
খালাসের পর ১৩ বছরের জেল
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নিতে জজ মিয়াকে সাজানো মামলায় কারাবন্দি করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার৷ এর আগে ২০০১ সালে মেয়েকে বিষ দিয়ে হত্যার অভিযোগে জাবেদ আলী নামের এক ব্যক্তির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়৷ দুই বছর পর উচ্চ আদালত থেকে তিনি বেকসুর খালাস পেলেও রায়ের কপি জেলখানায় না পৌঁছানোয় ১৩ বছর অকারণে জেল খাটেন তিনি।
কারাগারে বিয়ে
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন কারাগারে ধর্ষণ মামলার আসামিদের সঙ্গে ধর্ষণের শিকার নারীদের বিয়ের খবর প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যমে। ২০২০ সালের নভেম্বরে কুমিল্লার আদালতে ধর্ষণ মামলার আসামির সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ে হয়েছে৷ ১৯ নভেম্বর ফেনী কারাগারেও একই ধরনের বিয়ে হয়৷ একইদিনে নাটোরেও এমন একটি ঘটনা ঘটে৷ ২২ অক্টোবর উচ্চ আদালতের নির্দেশে রাজশাহীতে যাবজ্জীবন আসামি ও ভুক্তভোগীর কারাফটকে বিয়ে হয়৷
ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ
বাংলাদেশে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগার আছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, কারাগারগুলোর বন্দি ধারণ ক্ষমতা ৪০ হাজার ৯৪৪ আর বন্দির সংখ্যা ৮৮ হাজার ৮৪ জন। পরিস্থিতি এমন যে অতিরিক্ত গরমে হাজতিরা অসুস্থ হওয়া, এমনকি হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। তবে নতুন কারাগার নির্মাণ এবং পুরাতন কারাগার সম্প্রসারণ করে ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
টাকা থাকলে আয়েশে
তবে কারাগারে সবার সময় যে খারাপ কাটে তা নয়। টাকা থাকায় বেশ আয়েশেই দিন কাটে অনেকের। কয়েক দিন আগে প্রচারে এসেছে এমন এক ঘটনা৷ গাজীপুরে কাশিমপুর কারাগারে বন্দি আছেন অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত হল-মার্কের জিএম তুষার আহমদ। কারা কর্মকর্তাদের কক্ষে তিনি এক নারীর সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। জেলার থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এর বিনিময়ে তিনি ঘুস দিয়েছেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
হাসপাতালে জেল খাটা
কোনো অপরাধে বা অভিযোগে বন্দি হলে জেলখানার ১৪ শিক এড়ানোর একটি উপায় অসুস্থ হয়ে যাওয়া। অস্বাভাবিক আচরণ করে ফাঁসি স্থগিত ও পরে রাজনৈতিক প্রভাবে ছাড়া পেয়েছেন এমন ঘটনাও আছে। গত বছরের ২৫ জানুয়ারি প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘সম্রাটসহ ৭ বন্দি হাসপাতালে শুয়েবসে জেল খাটছেন’। তাদের মধ্যে আছেন স্বর্ণ চোরাচালান মামলার আসামি, ব্যবসায়ী, সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতা। ।
কারাগারে বিচারালয়
জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে ২০১৮ সালে কারাগারে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। গত বছর নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তির আগ পর্যন্ত তিনি বেশিরভাগ সময়ই বন্দি ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। এই সময়ে তার বিরুদ্ধে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার বিচারও চলে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে এই বিচারকাজের জন্য পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনকে আদালত হিসেবে ঘোষণা করে সরকার।
জেলখানা যখন জাদুঘর
পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারটি বাংলাদেশের দুই শতকের ইতিহাসের সাক্ষী। ১৮৬০-এর দশকে অনেক সিপাহীকে সেখানে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। পাকিস্তান শাসনামলে বঙ্গবন্ধুসহ স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতারা বারবার বন্দিত্ব বরণ করেছিলেন এই কারাগারে। এখানেই ঘটে জেল হত্যার ঘটনা। ২০১৬ সালে কারাগারটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করে সরকার। সেখানে টিকিট কেটে ইতিহাসে বিচরণ করতে পারেন দর্শনার্থীরা।
কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র?
দুটি কিশোর ও একটি কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র আছে গাজীপুর ও যশোরে। উদ্দেশ্য যেসব শিশু-কিশোররা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তাদের সংশোধন, শিক্ষা, বৃত্তিমূলক দক্ষতা ও মানসিকতার উন্নয়ন ঘটানো। বিভিন্ন সময়ের সংবাদে দেখা যায়, সেগুলো শিশুদের জন্য নির্যাতন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে যশোরে কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তিন কিশোরকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে। ১৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হয় এই ঘটনায়। (প্রতীকী ছবি)