কলকাতায় নজরুলের পাঁচ দশক
১৮৯৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে যার জন্ম, আজন্ম তিনি ছিলেন জীবনপথের এক পথিক। কাজী নজরুল ইসলামের এই পরিক্রমার সাক্ষী কলকাতা। পাঁচ দশকের বেশি সময়ের সেই স্মৃতি মুছে যাওয়ার মুখে। ছবিঘরে বিস্তারিত...
দুখুমিঞার শহর
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়া নজরুল তখন টগবগে যুবা। ১৯২০ সালে আসেন কলকাতায়। প্রথমে বাদুড়বাগানের একটি বাড়িতে ওঠেন। ১৯২১-এ ঠিকানা ৩২এ কলেজ স্ট্রিট। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের বিপরীতে। এখানে ছিল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির কার্যালয়। কবির সঙ্গী বন্ধু মুজাফফর আহমেদ।
২৮ বার বাসাবদল
সদা চঞ্চল, প্রাণশক্তিতে ভরপুর নজরুলের এক জায়গায় মন টেঁকে না। গবেষক বাঁধন সেনগুপ্ত লিখেছেন, ১৯২০ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে তিনি ২৮ বার ঠিকানা বদলেছেন। ১৯২১-এর এপ্রিলে থাকতে শুরু করেন ৪৭/১ মির্জাপুর স্ট্রিটে। এখনকার সূর্য সেন স্ট্রিটে অটুট দাঁড়িয়ে সেই মেসবাড়ি। নীচে কবির স্মরণে গড়ে উঠেছে নজরুল গ্রন্থাগার।
'বিদ্রোহী'র আঁতুড়ঘর
সাহিত্যিক থেকে সম্পাদক। ‘নবযুগ’ পত্রিকার সম্পাদনায় হাত পাকান কবি। সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’র প্রস্তুতি চলে, কলম ধারালো হতে থাকে। নতুন বাসা ৩/৪সি তালতলা লেনে জন্ম হয় নতুন কবিতার। দুখুমিঞা লেখেন ‘বিদ্রোহী’। ১৯২১-এর ডিসেম্বরের এক সকালে সেই কবিতার প্রথম পাঠক রুমমেট কমরেড মুজাফ্ফর।
'একই বৃন্তে দুটি কুসুম'
এই উদ্দাম, বেহিসেবি বেঁচে থাকার মধ্যে এসে পড়েন প্রমীলা সেনগুপ্ত। ১৯২৪-এর ২৫ এপ্রিল কবির সঙ্গে তার বিয়ে। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানীতে বসে ‘জাতের নামে বজ্জাতি’তে ঘা দিলেন নজরুল। কিন্তু থিতু হতে পারলেন না। শহর ডিঙিয়ে গেলেন হুগলি, নদিয়ায়। ১৯২৪-২৬ সপরিবার দুই জেলার বিভিন্ন ঠিকানায় কবির বাস। এই পর্বেই জন্ম কবির জ্যেষ্ঠ পুত্র কাজী আজাদ কামাল ও দ্বিতীয় পুত্র অরিন্দম খালেদ ওরফে বুলবুলের।
কবিতার 'সওগাত'
কলকাতার জন্য পিছুটান ছিল। ১৯২৮-এ এসে উঠলেন ১১, ওয়েলেসলি স্ট্রিটে। এখন নাম রফি আহমেদ কিদোয়াই রোড। ‘সওগাত’ পত্রিকার দপ্তর ছিল এখানে। প্রমীলা ও বুলবুলকে নিয়ে কিছু দিন ছিলেন। সেই বছরই কবির তৃতীয় পুত্র কাজী সব্যসাচীর জন্ম।
বুলবুলের বিদায়
শোভাবাজারের কাছে মসজিদবাড়ি স্ট্রিট। ৫০/২ নম্বরের জীর্ণ বাড়ি কবিজীবনের সাক্ষ্য নিয়ে আজো দাঁড়িয়ে। বেঁচে থাকার লড়াই ক্রমশ তীব্র হচ্ছিল নজরুলের। তার মধ্যে ফের শোক। এই বাড়িতেই মাত্র চার বছর বয়সে মৃত্যু হয় বুলবুলের। সাল ১৯৩০।
'স্বপ্নে দেখি একটি নতুন ঘর'
কলকাতায় একের পর এক বাড়ি বদল করতে হয় নজরুল-প্রমীলাকে। ১৯৩১ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে জেলিয়াটোলা স্ট্রিট, হরি ঘোষ স্ট্রিট, শ্যামপুকুর স্ট্রিট, সীতানাথ রোডের মতো কত ঠিকানায় পরিক্রমা এই দম্পতির। সেই বিলীয়মান স্মৃতি ধরে রাখার উদ্যোগ খুব কম। কয়েকটি বিক্ষিপ্তভাবে নজর কাড়ে একুশ শতকের কলকাতার।
'শূন্য এ বুকে'
১৯৪১-৪২ থেকে কবি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভারতের অন্যান্য শহর, এমনকী ইউরোপেও যান চিকিৎসার জন্য। গবেষক বাঁধন সেনগুপ্ত লিখেছেন, "১০ মে ১৯৫৩ তারিখে রওনা হয়ে কবি জাহাজে জলপথে ইংল্যান্ডে যান (১১ জুন)। পরে যান ভিয়েনায় (১০ ডিসেম্বর)। পূর্ব জার্মানির বন হয়ে সাত মাস পর কবি বিমানে কলকাতায় ফিরে আসেন (১৪ ডিসেম্বর)।"
ভারতরতনের জন্মদিনে
ভারত স্বাধীন হয়। তৈরি হয় ধর্মনিরেপক্ষ সংবিধান। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে এমন জয়ের পরেও নীরব ভারতরতন নজরুল। কলম থামেনি বটে, সাদা কাগজে শুধু আঁকিবুঁকি কাটতেন! টালা পার্কের এই বাড়ির তিনতলায় তার জন্মদিনে দর্শনার্থীদের ভিড় জমতো। এখানে কবিকে আরো নিঃসঙ্গ করে ১৯৬২ সালে বিদায় নেন প্রমীলাও।
কবির নীরবতা
টালার বাসিন্দা, বাচিকশিল্পী জগন্নাথ বসু স্মৃতি থেকে লিখেছেন, জন্মদিনে কবিকে দেখেছেন তিনি। প্রখর গ্রীষ্মে অনুরাগীরা বাড়ির সামনে লাইন দিতেন। ফুল দিতেন তার পায়ে। তখন নির্বাক, শোকতাপের ঊর্ধ্বে নজরুল। এখন সরকারি উদ্যোগে হইহই করে পালন করা হয় তার জন্মদিন। স্কুল, পাড়া, গ্রন্থাগারে পালিত হয় নজরুলজয়ন্তী।
কলকাতা থেকে ঢাকায়
কলকাতায় বাসের শেষ ১০ বছর কবির কাটে প্রায় নিভৃতে। পদ্মপুকুরের ক্রিস্টোফার রোডে পুত্র কাজী সব্যসাচীর ফ্ল্যাটে। এখনো একই রয়েছে ‘এল’ ব্লকের ফ্ল্যাট নম্বর চার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা জানান ভারত সরকারকে। ১৯৭২-এ এই বাড়ি থেকেই বাংলাদেশে যান কাজী নজরুল ইসলাম।