কওমি আলেমরা চান না ভাস্কর্য হোক
৫ ডিসেম্বর ২০২০ভাস্কর্য ইস্যুতে দেশের চলমান অস্থিরতা ও সংকট নিরসনে শনিবার দেশের ৯০ জন আলেম ঢাকার যাত্রাবাড়ি মাদ্রাসায় করণীয় ঠিক করতে বৈঠকে বসেছিলেন৷ এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড- বেফাকের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল্লামা মাহমূদুল হাসান৷ সেখানে সর্বসম্মত ৫ দফা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে৷ সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে প্রধান হল, মানবমূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণ ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ৷ তারা বলেন, এটা শরীয়া সম্মত নয়৷
এছাড়া ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে অবমাননা, ব্যাঙ্গাত্মক ও বিষদগারের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানো হয়৷ এখন পর্যন্ত ইসলামপন্থি নানা আন্দোলনে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের নিঃশর্ত মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করা হয়েছে৷ আলেমগণ ওয়াজ মাহফিলে লাউড স্পিকার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করেন৷ এছাড়া আলেমদের বিরুদ্ধে বিনা কারণে বিষোদগার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়৷
সরকারকেই ভাঙতে হবে!
বৈঠকের উদ্ধৃতি দিয়ে হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক মাওলানা জাকারিয়া নোমান ফয়েজী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই বৈঠকে দেশের শীর্ষ ১০০ জন আলেমকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল৷ ৯০ জন উপস্থিত ছিলেন৷ চলমান অস্থিরতা ও সংকট নিরসনে এই বৈঠক ডাকা হয়েছিল৷''
ভাস্কর্য ইস্যুতে হেফাজতের নতুন কোন কর্মসূচি আছে কি-না বা সরকার তাদের কথা না শুনলে হেফাজত কী করবে? জানতে চাইলে মাওলানা ফয়েজী বলেন, ‘‘শীর্ষ নেতারা এগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন৷ তবে আমরা মূর্তি (ভাস্কর্য) ভাঙব না৷ সরকার নির্মাণ করলে সেটা সরকারকেই ভাঙতে হবে৷''
তবে ভাস্কর্য নিয়ে হেফাজতের এই অবস্থানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে সরকারী দল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন৷ তারা হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাসহ বিভিন্ন ধরনের দাবি করেছে৷ এই আন্দোলন ও পাল্টা আন্দোলনের মধ্যে কুষ্টিয়া শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ে রাতের আঁধারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মাণাধীন ভাস্কর্যের কিছু অংশ ভেঙে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা৷ শুক্রবার রাতের কোন এক সময় নির্মাণাধীন এ ভাস্কর্যের মুখ ও হাতের অংশে ভাঙচুর করা হয়৷
এক সপ্তাহেই সমাধান?
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শনিবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘‘বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী দেখভাল করছেন৷''
একই দিন জামালপুরে এক অনুষ্ঠানে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান বলেছেন, ‘‘এক সপ্তাহের মধ্যে বিষয়টির সুরাহা হয়ে যাবে৷''
তবে বিষয়টি সাধারণভাবে না দেখতে বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এরা নারী শিক্ষার বিরোধী৷ এদের চরিত্র সবাই জানে৷ এদের কোনভাবে ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না৷ প্রশাসনের উচিৎ সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করে এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা৷ ভাস্কর্য ইতিহাসের অংশ৷ এরা ইতিহাস মুছে ফেলতে চায়৷ এরা পারলে মুক্তিযুদ্ধকেও মুছে ফেলতে চায়৷''
অন্যদিকে শক্তি ব্যবহার নয়, আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমি ভাস্কর্যের পক্ষে৷ তবে সরকারি শক্তি ব্যবহার করে তাদের দমন করার চেয়ে, আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হলেই ভালো৷ আসলে সবকিছুর জন্য গণতন্ত্র দরকার৷ আমাদের এখানে তো গণতন্ত্র নেই৷ ফলে এসব কথা বলে লাভ কি? কে শুনবে আমাদের কথা?''
সচল হচ্ছে ২০১৩ সালের মামলা
এদিকে হেফাজতের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানেই যাচ্ছে সরকার৷ নতুন করে সচল হচ্ছে হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে করা ১২টি মামলা৷ দীর্ঘ সাত বছর ঐ মামলাগুলো ঘুমিয়ে ছিল৷ হেফাজতের বর্তমান আমীর জুনায়েদ বাবুনগরীসহ অনেক হেফাজত নেতা এই মামলার আসামী৷ ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব চালায় হেফাজত৷ তারা দোকানপাটে আগুন লাগিয়ে দেয়, ভাঙচুর করে সরকারি বেসরকারি গণপরিবহন, বহু মানুষকে নির্মমভাবে পেটায়৷ হেফাজতের তাণ্ডবে ১৪ জন মারা যায়৷ নারকীয় এই তাণ্ডবের পর হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা হয়৷ এর মধ্যে পুলিশের করা ৫ মামলা ছাড়াও আক্রান্ত এবং ক্ষতিগ্রস্থরা করেন বাকী ৭ মামলা৷ সরকারকে উৎখাতের হুমকি দেওয়ায় বাবুনগরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলাও হয়৷ ওই মামলায় তিনি গ্রেফতারও হন৷ কিন্তু আল্লামা শফীসহ হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সুসম্পর্ক হওয়ার পর মামলাগুলো ঘুমিয়ে পড়ে৷
হেফাজতের মামলা সচল করার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার ওয়ালিদ হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মামলা কখনও ঘুমিয়ে পড়ে না৷ কোন মামলার তদন্ত করতে বেশি সময় লাগে, কোন মামলা তদন্ত দ্রুত শেষ হয়ে যায়৷ মামলা সবসময় চলমান৷ অনেক সময় আসামী গ্রেফতার বা সবকিছু গুছিয়ে চার্জশিট দিতে একটু বিলম্ব হয়৷ বিদ্যমান মামলাগুলোও তদন্ত চলছে৷ সময় হলেই চার্জশিট দেওয়া হবে৷''