1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

এক দিনে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই হত্যাকাণ্ড

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সদলবলে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে৷ প্রধান উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এর বিরুদ্ধে মুখ খুললেও তার কাঙ্খিত প্রভাব এখনো দৃশ্যমান নয়৷

https://p.dw.com/p/4krcl
নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দের ব্যানারে রাস্তায় মিছিলে একদল শিক্ষার্থী
সারাদেশে মব ভায়োলেন্সের প্রতিবাদ জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল করেছে নিপিড়নবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দছবি: Samsul Haider Badsha

সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেয়ার পর এমন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন দুই তরুণ৷ দুটিরই ঘটনাস্থল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বুধবার রাতে  তোফাজ্জল হোসেন নামে এক যুবককে ‘চোর’ অপবাদে রীতিমতো পরিকল্পনা করে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ৷ একই দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম আহমেদ, ওরফে শামীম মোল্লাকে৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে বুধবার রাতে তোফাজ্জল হোসেনকে ঘোরাফেরা করতে দেখে প্রথমে আটক করা হয়৷ একদফা মারধর করে রাতের খাবার খাওয়ানো হয় তাকে৷ খাওয়ানোর পর আবার শুরু হয় মারধর৷ এক সময় অচেতন হয়ে পড়লে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয় তাকে৷ রাত একটার দিকে তোফাজ্জল মারা যান৷ তার মৃত্যুর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়৷ এ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীকে আটক করেছে পুলিশ৷

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে বুধবার বিকালে ক্যাম্পাসে একদল শিক্ষার্থী প্রথমে আটক করে৷ তাদের অভিযোগ- ১৫ জুলাই রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ওপর হামলাকার ঘটনায় শামিমও জড়িত৷ আটকের পর কয়েক দফা পেটানো হয়৷ অবস্থা সংকটাপন্ন হলে তাকে সাভারের গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে নেয়া হয়৷ রাত ৯টার পর তিনি মারা যান৷

কথিত একজন সমন্বয়কও জড়িত বলে জানতে পেরেছি: ইসমাইল হোসেন

তার মৃত্যুর পর বুধবার রাতেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে তথাকথিত ‘মব জাস্টিস'-এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল হয়৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ মিছিলের ভিডিও৷ মিছিলে ‘ক্যাম্পাসে খুন কেন, প্রশাসন জবাব চাই', ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা কেন, মানি না মানবো না', ‘প্রশাসন কী করে, ক্যাম্পাসে খুন করে', ‘প্রশাসন কী করে, প্রক্টর অফিসে খুন হয়', ‘সন্ত্রাসীদের বের করো, ক্যাম্পাস থেকে, হল থেকে’, ‘নিরাপত্তা অফিসে খুন করে, প্রশাসন কী করে’, ইত্যাদি স্লোগান দেয়া হয়৷

বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে এমন হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিল হয়৷

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল(অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বৃহস্পতিবার এসব ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, "আইন কারো হাতে তুলে নেয়ার অধিকার নেই৷ সবাইকে সচেতন হতে হবে৷”

এ সময় সারা দেশে ঢালাওভাবে হত্যা মামলা দায়েরের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘ঢালাও আসামি করায় তদন্তে সময় বেশি লাগছে এবং নির্দোষ ব্যক্তি হেনস্তার শিকার হচ্ছেন৷ পুলিশকে বলা হয়েছে ক্রিমিনাল ধরতে, সাধারণ মানুষকে নয়৷''

দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে একই রাতে দুটি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ইসমাঈল হোসেন সম্রাট ডয়চে ভেলেকে বলেন, " ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না৷ এর ভিডিও ফুটেজ আছে৷ সিসি ক্যামেরার ফুটেজ আছে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় একজন কথিত সমন্বয়কও জড়িত৷ সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে৷”

বাংলাদেশে ‘মব জাস্টিসের' ঘটনা আগেও ঘটেছে৷ তবে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এ প্রবণতা খুব বেড়ে যায়৷ শুরু হয় আদালত এলাকায় আসামীদের ওপর হামলার মাধ্যমে৷ পাশাপাশি চলে গণহারে মামলা দায়ের৷ বিভিন্ন অফিসে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢুকে কর্মকর্তা এবং শিক্ষকদের নানাভাবে চাপ প্রয়োগ ও হেনস্তা করে পদত্যাগে বাধ্য করার দৃশ্য দেখা যায় অনেক৷

গত ৮ সেপ্টেম্বর বগুড়ায় আদালত চত্বরে হামলার শিকার হন আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম৷ হামলার পর হিরো আলম বলেন, "এক স্বৈরাচারের পতনের পর আরেক দল নিজেদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ শুরু করেছে৷”

একই দিনে রাজশাহীতে পিটিয়ে হত্যা করা হয় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে৷ আট বছর আগে এক হামলায় একটি পা হারানো মাসুদ প্লাস্টিকের পা লাগিয়ে চলাফেরা করতেন৷ সেদিন ওষুধ কিনতে বের হলে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ মৃত্যুর চার দিন আগে এক কন্যা সন্তানের জনক হয়েছিলেন আব্দুল্লাহ আল মাসুদ৷

৫ আগস্ট সরকার পতনের তিন দিন পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়৷

দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো ক্লাস শুরু হয়নি৷ ৫০টির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রোভিসিকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে৷ দুই শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে জোর করে সরিয়ে দেয়া হয়েছে৷ শিক্ষকদের ওপরও হামলা হয়েছে অসংখ্য৷ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়েছে ২০১০টি৷

বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে হামলা ও আগুনের ঘটনাও ঘটেছে অনেক৷ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজী টায়ার নামের শিল্প প্রতিষ্ঠান কার্যত ধ্বংস করা হয়েছে৷

সম্প্রতি বেশ কিছু মাজারেও চালানো হয় হামলা৷ নারায়ণঞ্জের দেওয়ানবাগীর মাজারসহ কয়েকটি মাজার ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে৷ ঢাকার গোলাপ শাহ মাজারও ভেঙে দেয়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে৷ অনেক মাজারে এ মুহূর্তে গানবাজনা বন্ধ রয়েছে৷

‘সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দিয়েও খুব কাজ হচ্ছে না’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতার কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে৷ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও বিচার ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন বা উন্নতি আমরা দেখতে পাচ্ছি না৷ যে যার মতো মামলা করছেন৷ আবার আগের মতোই আসামিদের ইচ্ছেমতো রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে৷ আদালত এলাকায় হামলা হচ্ছে৷ ফলে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি এখনো দেখা যাচ্ছে না৷ এটা মব জাস্টিসকে উৎসাহিত করছে৷”

‘‘যদি শুরু থেকেই এই ঘটনাগুলো প্রতিরোধ করা যেতো, যারা আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন তাদের বিচারের আওতায় আনা হতো, তাহলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না,” বলে মনে করেন তিনি৷

দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া না গেলে এটা বন্ধ হবে না: ওমর ফরুক

তিনি বলেন, ‘‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্বরতম ঘটনা ঘটেছে৷ ওই যুবককে আটক করে ভাত খাওয়ানো হলো, মারধর করা হলো, হত্যা করা হলো৷ দীর্ঘ সময় ধরে এটা করা হয়েছে৷ তারপরও পুলিশ বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাকে রক্ষায় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদের দাবি, তারা খবর পাওয়ার পরই প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যদের নিয়ে সেখানে গিয়ে ওই যুবককে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেন৷ তিনি বলেন," আমরা এরই মধ্যে মামলা করেছি৷ এবং সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে পুলিশ তিনজনকে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করেছে৷ তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র৷ আরো যারা জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে৷”

মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘পরিস্থিতি এমন যে, পুলিশ বা সেনাবাহিনী এখনো জন প্রতিক্রিয়া কী হয় সেই চিন্তা মাথায় রেখে কোনো ঘটনায় ব্যবস্থা নিচ্ছে৷ ফলে অনেকে ক্ষেত্রেই যখন ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন, তখন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না৷ ফলে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দিয়েও খুব কাজ হচ্ছে না৷ আসলে পরিস্থিতির কারণে এমন হচ্ছে৷”

‘‘আমাদের মনে রাখতে হবে যে, গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, তার নেতৃত্বে রাজনৈতিক দল ছিল না৷ ছাত্ররা এর নেতৃত্ব দিয়েছে৷ ফলে দেশে একটা ভিন্নরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে৷”

‘সমন্বয়ক পরিচয় দেয়া বন্ধ করতে হবে'

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ইসমাইল হোসেন সম্রাট বলেন, ‘‘আমরা এই মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি৷ আমরা পুলিশকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে বলেছি৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের চিহ্নিত করা কোনো কঠিন কাজ নয়৷ তাদের ভিডিও ফুটেজ আছে৷ তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হোক৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় কথিত একজন সমন্বয়কও জড়িত বলে জানতে পেরেছি৷”

‘‘আমরা এই মব জাস্টিস, বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি৷ আমরা এর অবসান ঘটাতে সরকারের পতন ঘটিয়েছি৷ আগের মতোই যদি আবার হয়, তাহলে এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক৷ আমাদের এমন কোনো কাজ করা ঠিক হবে না যাতে এই ধরনের কাজ উৎসাহিত হয়,” বলেন তিনি৷

এর সমাধানের উপায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে৷ জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে৷ আর আমাদের সমন্বয়ক পরিচয় দেয়া বন্ধ করতে হবে৷ আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলণ একটি লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম, তা অর্জিত হয়েছে৷ স্বৈরাচারের পতন ঘটেছে৷ এখন আর আমাদের সমন্বয়ক থাকার দরকার নাই৷ এখন নানাভাবে নানা জন সমন্বয়ক পরিচয় দিচ্ছেন৷ ছাত্রলীগও সমন্বয়ক পরিচয় দিচ্ছে৷ তাই এখন আমাদের সমন্বয়ক পরিচয় দেয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷”

আর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফরুক বলেন, ‘‘এটা খুবই দুঃখজনক যে, যারা বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন, যারা সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছেন, তাদেরই কেউ কেউ মব জাস্টিসে জড়িয়ে পড়ছেন৷ এটা বন্ধ না হলে আমাদের যে অর্জন, তা নস্যাৎ হয়ে যাবে৷”

তার কথা, ‘‘আইনের শাসনই এর সমাধান৷ তাই যারা এর সঙ্গে জড়িত, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে৷ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া না গেলে এটা বন্ধ হবে না৷”

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান