1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঋণের বোঝায় কি কলকাতায় সপরিবারে আত্মহত্যার চেষ্টা?

২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বিপুল টাকা ঋণের বোঝা৷ সেই ঋণ শোধ করতে না পেরে কি সপরিবার মৃত্যুর পথ বেছে নেয়া? কলকাতার দে পরিবারের একাধিক সদস্যের মৃত্যুতে এই প্রশ্নই উঠে আসছে৷

https://p.dw.com/p/4qtlw
কলকাতা
লকাতার দে পরিবারের একাধিক সদস্যের মৃত্যুর ঘটনায় নানা প্রশ্ন উঠে আসছে৷ ফাইল ফটোছবি: Payel Samanta/DW

শহরের বুকে একই পরিবারের তিনজনের দেহ উদ্ধারের ঘটনা সবাইকে চমকে দিয়েছিল৷ ১৮ ফেব্রুয়ারি দেহ উদ্ধার হয়৷ সেদিনই দুর্ঘটনায় পড়ে এই পরিবারের একটি গাড়ি যার ভিতর তিন সদস্য ছিলেন৷

এই দুটি ঘটনার পিছনে যে নিখুঁত পরিকল্পনা ছিল, সেটা উঠে এসেছে তদন্তে৷ পুলিশের দাবি, কয়েক কোটি টাকা ধার হয়ে গিয়েছিল এই পরিবারের কর্তা, দুই ভাই প্রসূন ও প্রণয়ের৷ সেটা শোধ করতে না পারার জন্যই সপরিবার নিজেদের শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত৷ এ জন্য দুই ভাই কয়েকটি ওষুধের দোকান ঘুরে ঘুম ও প্রেশারের ওষুধ সংগ্রহ করেছিলেন৷ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুই ভাই ও পরিবারের এক নাবালক সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করে নানা তথ্য উঠে এসেছে৷

সূত্রের খবর, ১০ ফ্রেব্রুয়ারি নাগাদ সপরিবার আত্মহত্যার ছক কষা হয়৷ বাজারে প্রায় ১০ কোটি টাকার ঋণ শোধ করা সম্ভব নয় বুঝেই এমন পরিকল্পনা৷ ১২ তারিখ এই পরিকল্পনার কথা বলা হয় দুই স্ত্রীকে৷ তবে তাদের ছেলেমেয়েরা কিছুই জানত না৷

তদন্তকারীদের দাবি, দুই ভাই প্রণয় ও প্রসূনের বক্তব্য অনুযায়ী, ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে ঘুম ও প্রেশারের ওষুধ মিশিয়ে বানানো লস্যি বা পায়েস খেয়ে পরিবারের নাবালিকা সদস্য মারা গেলেও তাদের স্ত্রী সুদেষ্ণা ও রোমির মৃত্যু হয়নি৷ তারা অচৈতন্য হয়ে যান৷ ১৮ তারিখ সকালে ওই দু'জনকে গলার নলি ও হাতের শিরা কেটে খুন করা হয়৷

এরপর বেঁচে যাওয়া দুই ভাই নিজেদের দুর্ঘটনায় শেষ করে দেওয়ার ছক কষেন৷ সঙ্গে নেন এক ভাইয়ের পুত্র, ছোট্ট নাবালক সদস্যকে৷ ১৮ ফ্রেব্রুয়ারি রাত প্রায় একটায় গাড়ি নিয়ে বেরোন তিন জন৷ গাড়ি চালাচ্ছিলেন দাদা প্রসূন৷ ট্রাকে ধাক্কা মেরে আত্মহত্যার প্ল্যান করেন তারা৷ কোনা এক্সপ্রেস, দ্বিতীয় হুগলি সেতু, এজেসি বোস রোড, সেভেন পয়েন্ট, সায়েন্স সিটি, ইএম বাইপাস হয়ে অভিষিক্তায় পৌঁছে গেলেও এই পরিকল্পনা কার্যকর করতে পারেননি তারা৷ 

পুলিশের দাবি, শেষে অভিষিক্তার কাছে বাইপাসে মেট্রো রেলের সাত নম্বর পিলারে এসে সজোরে ধাক্কা মারে গাড়ি৷ তখন গাড়ির গতি নাকি ঘণ্টায় প্রায় ১৩০ কিমি ছিল৷ দুর্ঘটনার আগে গাড়ির সামনে সিট থেকে নাবালককে পিছনে পাঠানো হয়৷ সামনে চলে আসেন ভাই আসেন প্রণয়৷ এরপরে দুই ভাই সিটবেল্ট খুলে পিলারে ধাক্কা মারেন৷ কিন্তু তিনজনই বেঁচে যান৷

এভাবে নিজেদের শেষ করে দেয়ার রোমহর্ষক ছক যে কষা সম্ভব, সেটাই বিস্ময় জাগাচ্ছে৷ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে তারা মরিয়া ছিলেন, যেহেতু পাওনাদারদের চলতি মাসেই টাকা শোধ করার কথা দেয়া ছিল৷

তদন্তকারীদের দাবি, ১৩ তারিখ থেকে বিভিন্ন ওষুধের দোকান ঘুরে কেনা ওষুধ  ১৭ ফেব্রুয়ারি স্ট্রিপ থেকে বার করা হয়৷ এরপর স্ট্রিপ পুড়িয়ে ফেলেন বা নষ্ট করে দেন তারা৷ সেদিনই সেই ওষুধগুলো দুধের সঙ্গে মিশিয়ে লস্যি বা পায়েস বানানো হয়৷ তারপরে সেটা সকলে খেয়ে শুয়ে পড়েন৷

কিন্তু তাতে সকলের মৃত্যু হয়নি৷ শুধু নাবালিকার মৃত্যু হয়েছিল৷ যদিও তার মৃত্যু নিয়ে ধন্দে রয়েছে পুলিশ৷ ময়নাতদন্তের রির্পোট অনুযায়ী, নাবালিকার শরীরে কালশিটে দাগ রয়েছে৷ মাথায় রক্ত জমাট বেঁধেছিল৷

এই বীভৎস ঘটনার নেপথ্যে অভাব বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা, যাই থাক, এভাবে গণ আত্মহত্যার পরিকল্পনা দেখে স্তম্ভিত মনোবিশ্লেষকরা৷

অ্যানোমিক সুইসাইডের সঙ্গে এর মিল আছে: সুহৃতা সাহা

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন বিভাগের অধ্যাপক সুব্রত সাহা ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘যেকোনো মনোবৈজ্ঞানিক সমস্যার সঙ্গে একাধিক সামাজিক, মনোবৈজ্ঞানিক, এবং পারিপার্শ্বিক বিষয় যুক্ত হয়৷ তার থেকে একটা প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়৷ ট্যাংরার ঘটনার ক্ষেত্রে মৃত্যু চাওয়ার তীব্রতা এমন চরম অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছে যে, বাস্তব থেকে মানুষ অনেক দূরে চলে গিয়েছে৷ মৃত্যু গ্রহণ করলেই যে তার মুক্তি, এরকম একটা বিশ্বাস তাদের মধ্যে জন্মেছে৷’’

অধ্যাপক বলেন, ‘‘এক্ষেত্রে মানুষ কখনই ভাবতে পারে না যে, জীবনটা অনেক বড়৷ তার ভিতরে যে ঘটনাই ঘটে থাক, সেটা অত্যন্ত ছোট৷ সেটা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করাটাই উচিত৷ পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তিদের উপর নির্ভর করে তাদের পরিবার৷ তারা যদি কোনো কারণে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন, সেটা বাকিদের বিশেষত ছোটদের কাছেও খুব ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়ায়৷’’

ট্যাংরার ঘটনা দেখে অনেকের মনে পড়ছে দিল্লির বুরারির কথা৷ সেখানে ২০১৮ সালে একটি পরিবারের ১১ জনের দেহ মিলেছিল৷ গণ-আত্মহত্যার তত্ত্ব উঠে এসেছিল সেই সময়ে৷

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের বিভাগীয় প্রধান সুহৃতা সাহা ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘ট্যাংরার ব্যবসায়ী পরিবার হঠাৎ করে অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি হয়, সমাজতত্বের ভাষায় অ্যানোমিক সুইসাইডের সঙ্গে এর মিল আছে৷ তারা আর্থিক ক্ষতির জন্য সমাজের নিয়ম-কানুন মেনে উঠতে পারছিলেন না৷ এতে ক্যাপিটালিজমেরও দায় আছে৷ মানুষের লোভ যেমন আছে, তেমনি সিস্টেম তাকে সেই লোভের দিকে এগোতে সাহস জোগায়৷’’

পাশাপাশি ট্যাংরার ঘটনায় পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের পরিচয় আছে বলে অধ্যাপিকার মত৷ বলেন, ‘‘বাড়ির পুরুষরা ঠিক করে নিয়েছেন, মেয়েরা কীভাবে মারা যাবেন৷ সে অর্থে মেয়েরা বাড়িতে মারা গিয়েছেন৷ একজন পুরুষ যখন আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন বাড়ির নারী এবং শিশুটির হয়ে৷’’

বিষয়টিকে পণ্যবাদের সঙ্গে জুড়ছেন মনো সমাজকর্মী মোহিত রণদীপ৷ তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘বিলাসী জীবনযাত্রা ছেড়ে আমরা কোনো মতেই বেরোতে পারি না, যখন আমরা ধাক্কা খাই৷ এটা এক ধরনের পণ্যবাদ৷ পুরনো জীবনযাত্রা থেকে বেরোলে তাদের সামাজিক মর্যাদায় বিচ্যুতি ঘটবে, অন্যদের চোখে ছোট হয়ে যাবেন, এরকম একটা ভ্রান্ত ধারণা হয়তো তাদের মনে থাকতে পারে৷ করোনার সময়ে যাদের জীবনযাপন মধ্যবিত্ত স্থানের ছিল, তাদের অনেকেই নিম্ন-মধ্যবিত্ত স্তরে নেমে এসেছেন৷ তবুও তারা আত্মহনন করেননি৷ এক্ষেত্রে কোথাও মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা থাকতে পারে৷''

কী ধরনের মনের অসুখ? রণদীপের বক্তব্য, ‘‘দে পরিবারের সদস্যরা বিষন্নতার শিকার হয়েছিলেন, না হলে এ ধরনের পরিণতির কথা তারা ভাবতে পারতেন না৷ হয়তো নিজেরাও যে বিরাট ধনী, এই আত্মশ্লাঘা তাদের মধ্যে কাজ করত, এটা থেকে তারা বেরোতে পারেননি৷ এই পরিণতির কারণ হয়ত সেখানেই লুকিয়ে আছে৷’’

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷