নাজেহাল মহানগরের সংখ্যালঘুরা
১৩ জুলাই ২০১৮তোমার ঘরে বাস করে কারা
কলকাতার মতো সাংস্কৃতিক নগরে মনের দরজাটা অনেকেই খোলেননি৷ বরং ঘরের অন্দরে থাকা মানুষগুলিকে অযথা সন্দেহ করেছেন৷ মুহাম্মদ আসিফ ইকবালের এমনই অভিজ্ঞতা৷ তাঁর কলেজের তিন বন্ধু কলকাতায় কোচিংয়ের স্বার্থে ইএম বাইপাসের ধারে একটা মেসে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন৷ মেস মালিক তাঁদের উঠিয়ে দিয়েছেন৷ তাঁর বক্তব্য, তিনি জানতেন না যে তাঁরা মুসলিম, আগে জানলে থাকতেই দিতেন না৷
কোচবিহারের অনিন্দ্য রায় আহমেদ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে এখানে বাড়িভাড়া পাননি৷ এমনকি গৃহহীন অবস্থাতেও কাটিয়েছেন এই মহানগরীতে৷ ২১ বছরের এই তরুণের কলকাতা নিয়ে মোহভঙ্গ হয়েছে৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ভেবেছিলাম কলকাতা অনেকটা উদার৷ কিন্তু বাড়িভাড়া পাওয়ার ক্ষেত্রে শুধু ধর্মীয় পরিচয়টাই বড় হয়ে দাঁড়ালো?''
বায়োকেমিস্ট্রির স্নাতক স্তরের ছাত্রী মুর্শিদাবাদের তনভি সুলতানাকে যাদবপুরের বাড়িওয়ালা কীসের ভিত্তিতে নাকচ করলেন? তনভি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘প্রথমে আমার মুখ দেখে ওঁরা বোঝেননি যে আমি মুসলিম৷ সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে অলমোস্ট, আমি নিজে থেকে জানালাম আমি মুসলিম, হ্যাঁ গন্ডগোলটা এখানেই হলো....আমি মুসলিম বলে আমাকে রুম দেওয়া যাবে না৷''
তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে
ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কবীর সুমন কলকাতার এই ছবিটার কথাই তুলে ধরেছিলেন৷ সংখ্যালঘুরা এমনভাবেই প্রতিনিয়ত প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন৷ ব্যক্তিগত জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাসে বাড়িওয়ালার শর্ত মেনে নিলেও হামেশাই তাঁরা কেবল মুসলমান হওয়ার অপরাধে বাড়ি ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন৷ ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন – বাড়িওয়ালাদের কাছে মুসলমান মানেই কি সবাই সন্ত্রাসবাদী, অসামাজিক, নাহলে নোংরা, বর্বর?
এ রোগ শুধু কলকাতায় নয়, বহরমপুর বা ডায়মণ্ড হারবারের মতো জায়গাতেও বেশ ক্ষত ছড়িয়েছে৷ তবে কি সারা দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গৈরিকীকরণের পথে হাঁটছে পশ্চিমবঙ্গও? যেখানে বাড়ি বা মেস নেওয়ার ক্ষেত্রে ধর্ম পরিচয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে বাধা৷ কবীর সুমনের কথার রেশ ধরেই বলতে হচ্ছে, বাড়িওয়ালারা কি সব গেরুয়া ধ্বজাধারী হয়ে গেলেন?
জাতের নামে বজ্জাতি সব
এই কলকাতাতেই হিন্দু স্ত্রী প্রমীলা সেনগুপ্তকে নিয়ে বাড়িভাড়া করে ছিলেন কাজী নজরুল৷ যুগ পালটেছে৷ তবুও ফেসবুকে তনভি ক্ষোভ উগরে দিতেই কলকাতার একদল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তাঁর পাশে দাঁড়ালেন৷ আর তাতেই তনভির বাড়িওয়ালা ভুল বুঝতে পেরে তাঁকে ফেরত নিয়ে গিয়েছিলেন৷ তনভির পর অন্যদেরও এভাবেই বাড়ি বা মেস নিয়ে জাতধর্মের বৈষম্য থেকে নিষ্কৃতির উপায় খুঁজতে ফেসবুকেই ‘সংহতি অভিযান' শুরু করেছেন তাঁরা৷ সম্প্রীতির ডাক দিয়ে তাঁরা খুলেছেন ‘ওপেন এ ডোর' নামের একটি গ্রুপ৷ এখানে ৪০০-৫০০ বাড়িওয়ালার তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা হয়েছে, যাঁরা বাড়িভাড়া নিয়ে ধর্ম-লিঙ্গের বিভেদ করবেন না৷ অনিন্দ্য বা তনভির মতো আর কেউ যাতে এমন সমস্যায় না পড়েন, তাঁরা সে চেষ্টা করছেন৷
কিন্তু এ রাজ্যের বিক্ষিপ্ত পটভূমিতে এটুকু করলেই চলবে না৷ এমনটা মনে করেন ‘ওপেন এ ডোর'-এর অন্যতম সদস্য দ্বৈপায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তাঁর মতে, মানুষের মনে যে বিভেদের বীজ রয়েছে, তা সমূলে উৎখাত করতে প্রয়োজন প্রচার এবং সচেতনতা৷ এ জন্য কলেজের সামনে এবং পাড়ায় পাড়ায় প্রচার জরুরি৷ সংগঠনের সদস্য স্বাগত চক্রবর্তী বলেন, ‘‘বাড়িওয়ালারা কাকে বাড়িভাড়া দেবেন, সেটা একান্তই তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপার৷ সংবিধান বা আইনে এ ব্যাপারে কিছু বলা নেই৷ তাই মানুষকে নিজের পড়শি বা ভাড়াটে সম্পর্কে উদার হতে হলে আগে সচেতন হতে হবে৷ সেই সচেনতার কাজই করছি আমরা৷ মানুষকে বোঝাচ্ছি, প্রয়োজনীয়তা দেখে ঘর ভাড়া দিন, ধর্ম বা জাতপাত দেখে নয়৷'' কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র স্বাগত নিজের শিকড় কাটোয়াতেও এইরকম পরিস্থিতি দেখেছেন৷ এই গ্রুপে শুধু কলকাতা নয়, সারা রাজ্যের বাড়িভাড়া বা পেয়িং গেস্টের সন্ধান দেওয়া বা নেওয়া যাবে৷ কারো বাড়ি দরকার হলে বা বাড়িভাড়া দেওয়ার দরকার হলে এই গ্রুপে পোস্ট করতে পারবেন৷ তবে শর্ত একটাই, জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ-বর্ণ নির্বিশেষে ভাড়াটে রাখতে হবে৷ বাছবিচার করতে পারবেন না৷
প্রথিতযশা সাহিত্যিক আবুল বাশার এমন সংহতি অভিযানকে ভীষণই স্বাগত জানিয়েছেন৷ তিনি এককালে নিজেও যাদবপুর অঞ্চলে বাড়িভাড়া পেতে সমস্যায় পড়েছেন৷ সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘দেশ পত্রিকায় কাজ নিয়ে যখন কলকাতায় এলাম, তখন যাদবপুরে আমার জন্য বাড়ির খোঁজ করা হয়েছিল৷ কিন্তু মুসলিম বলে বাড়ি পাওয়া যাচ্ছিল না৷ অর্থাৎ, এই সমস্যা দীর্ঘদিনের৷ সংহতি অভিযান যদি এই সমস্যা দূর করতে পারে, তাহলে সেটা দারুণ ব্যাপার হবে৷''
ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ভারতে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনে অনুমোদন নেই৷ এই দেশ কাজী নজরুলের মতো এক অনন্যসাধারণ অসাম্প্রদায়িক ব্যাক্তিত্বের জন্ম ও কর্মভূমি৷ তাই সেই চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখা খুব জরুরি বলে মনে করেন আবুল বাশার৷ সাহিত্যিকের মতে, হিন্দু ও মুসলমানের মৈত্রী এই সময়েও খুবই দরকার৷ সেটা শুধু ভারতের জন্য নয়, গোটা উপমহাদেশের জন্য৷
মন জানলা খুলে দে না
সব সময় যে বাড়িওয়ালারাই যে একপেশে, তা নয়৷ ঈশিতা মিত্র, আফরোজা খাতুন, সায়ন্তনী খাঁ এঁদের অনেকের গল্প কিন্তু আলাদা৷ ধর্ম-বর্ণের বাছবিচার করে এঁরা বাড়িভাড়া দেন না বা পেয়িং গেস্ট রাখেন না৷ উল্টে সায়ন্তনী এমনও দেখেছেন যে, পেয়িং গেস্ট বা ভাড়াটেরা বরং এ ব্যাপারে বেশি কৌতূহলী৷ আফরোজা খাতুনও তাঁর ভাড়াটেদের ক্ষেত্রে এমন বাছবিচার করেন না৷