1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আল জাজিরার প্রতিবেদন: পুলিশের প্রতিবাদ ও কিছু প্রশ্ন

৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

আল জাজিরার প্রতিবেদনের পর যাদের তদন্ত করার কথা, তারাও তা না করে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন৷ যাদের প্রশ্ন তোলার কথা তারাও প্রতিবাদই করছেন ৷ কেউ কোনো প্রতিবেদন করলেই যদি তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে আক্রমণ শুরু হয়, তাহলে প্রশ্নটা তুলবে কে?

https://p.dw.com/p/3p41I
Screenshot Youtube Al Jazeera | Männer der Premierministerin
ছবি: youtube.com/Al Jazeera English

সরকার যেমন প্রতিবেদনের কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তাকারীদের এক কথায় জামায়াত-শিবির বানিয়ে দিচ্ছে, তেমনি কিছু কনটেন্ট নিয়ে প্রশ্ন তোলা ব্যক্তিদেরও আলোচনার সুযোগ না দিয়ে আওয়ামী লীগ বানিয়ে দিচ্ছে আরেক পক্ষ। সমাজকে এমন বিভক্ত অবস্থায় নেয়া হয়েছে যে, ‘নিরপেক্ষ' অবস্থানে থেকে আলোচনা-সমালোচনার কোনো সুযোগই কাউকে দেয়া হচ্ছে না। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে আপনাকে ততক্ষণই ‘নিরপেক্ষ' হিসেবে বিবেচনা করা হবে যতক্ষণ আপনার কথা তার পক্ষে যাচ্ছে৷

প্রতিবেদন প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো তথ্য আমলে না নিয়েই ‘উদ্দেশ্য প্রণোদিত', ‘অপপ্রচার' ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে প্রতিবেদন খারিজ করে দিচ্ছেন৷ পররাষ্ট্র মন্ত্রী জানিয়েছেন সরকার মামলা করার কথা ভাবছে৷ প্রতিবেদনে যদি কয়েক শতাংশও সত্যি কথা থেকে থাকে, তাহলে মামলা করলে সরকারেরই উলটো বিপদে পড়ার শঙ্কা থাকে৷ ফলে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে এমন মামলা করার হুঁশিয়ারি কেবল কথার কথা বলেই ধরে নিচ্ছি৷

এদিকে, এডিটরস গিল্ড, আইএসপিআর, অনেকেই একই ধারা অনুসরণ করে যেসব তথ্য দেখানো হয়েছে, তা নিয়ে কোনো কথাই বলছেন না৷ আল জাজিরার প্রতিবেদনে অনেক কিছু নিয়েই খটকা রয়েছে, তেমনই অনেক তথ্য তদন্তের দাবিও রাখে৷ অথচ, সেই দাবিটুকু জোরেশোরে কেউ তুলছেন না

যেহেতু দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তা তদন্তের দায়িত্ব মূলত পুলিশের কাছেই যায়, তাই এ বিষয়ে পুলিশের বক্তব্য অন্যদের চেয়ে বেশি গুরুত্বই বহন করে৷  অন্যদের মতো বিবৃতি দিয়ে দায় স্বীকার না করে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন রীতিমতো ভিডিও বানানোয় বেশ আগ্রহ নিয়েই দেখতে বসলাম। ভিডিওতে যা বলা হয়েছে, তার চেয়ে যা বলা হয়নি সেটার পরিমাণই বেশি।

ঝুঁকি আছে জেনেও প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় লেখা দরকার মনে করছি৷

১) যারা যুক্তি দিয়ে সব বিচার করতে পারেন না, তারা সাধারণত কথা শুরু করেন ব্যক্তি আক্রমণ দিয়ে। কারো কথা নিজের সঙ্গে না মিললেই তাকে আগে আওয়ামী লীগ, বা জামাত-শিবির বা বাম বা দালাল বানিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে সে ব্যক্তি বা কথা সম্পর্কে মানুষের একটা প্রিপারসেপশন প্রস্তুত হয়। ফলে এরপর যা-ই বলা হোক না কেন, যারা বিশ্বাস করার তারা নিজে চিন্তা না করেই তা বিশ্বাস করতে শুরু করেন।

এই ভিডিওতেও অভিযোগ খণ্ডনের আগে শুরুতেই অপপ্রচার, অসৎ উদ্দেশ্য, মনগড়া, মিথ্যা তথ্য, ইত্যাদি শব্দ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

পুলিশের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলে জনগণের বন্ধু হিসেবে আগে সেটা আমলে নিয়ে তদন্ত করে তো দেখা উচিত, নাকি? এত বড় পুলিশ বাহিনী, কোথায় কী হয় সবাই জানেন? গত এক সপ্তাহের মধ্যে কোনো তদন্ত কি হয়েছে? নাকি 'ভাই কি দুর্নীতি করেন?' প্রশ্নের উত্তরে 'না, ভাই' শুনেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন?

২) নতুন আইজিপির অধীনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইজিপির নানা উদ্যোগের কাটিং দেখানো হয়েছে। হতে পারে যে নতুন আইজিপির অধীনে দুর্নীতি কমেছে। কিন্তু এটার পক্ষে পরিসংখ্যান কী, সুনির্দিষ্ট তথ্য বা জরিপ কই?

৩) ২০১৮ সালে দেশের শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল পুলিশ। বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন কিন্তু তখন সেটা চিহ্নিত করেনি, করেছে টিআইবি। এ বছরের ২৮ জানুয়ারি টিআইবি ২০২০ সালের দুর্নীতির ধারণার সূচক প্রকাশ করেছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স' ঘোষণা করা হলেও টিআইবি বলছে বিশ্বে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে ১২তম।

দুর্নীতির কারণ হিসেবে টিআইবি জানিয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমনে হতাশাজনক চিত্রের জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার, গণতন্ত্রের জবাবদিহির কার্যকারিতার অবদমন, বিচারহীনতার সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন উপাদান প্রভাব ফেলেছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর করোনা মোকাবিলায় নানান দুর্নীতি, উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিগ্রস্ত ‘রুই–কাতলা'দের বিচারের আওতায় আনার ঘাটতি, রাষ্ট্রীয় খাতে কেনাকাটায় রাজনৈতিক প্রভাব ও অনিয়ম, গণমাধ্যমের মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার বিষয়গুলোও একইভাবে দায়ী। দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। ব্যাংক খাতের দুর্নীতি তো আছেই।

সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি আছে, কেবল পুলিশে নেই? পুলিশই তো দেশের দুর্নীতি দমন করবে, দুর্নীতিবাজদের নির্মূল করবে। তা না হয়ে যখন বাংলাদেশ বিশ্বের ১২তম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হয়, তার মানে কী দাঁড়ায়?

আল জাজিরার প্রতিবেদন সত্য, আংশিক সত্য, নাকি মিথ্যা?

৪) দুর্নীতি দমনই যদি উদ্দেশ্য হয় তাহলে তো আগেই খারিজ না করে দিয়ে আল জাজিরার প্রতিবেদকদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ চাওয়া উচিত ছিল। সেই তথ্য অনুযায়ী সুস্পষ্ট তদন্ত চালানো উচিত ছিল। তথ্য-প্রমাণ মিথ্যা বা ভুয়া হলে আল জাজিরার বিরুদ্ধে মামলা করারও সুযোগ ছিল।

কিন্তু অভিযোগ পেলে তা তদন্ত করে তথ্য-সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা৷ এক্ষেত্রে তা করা হচ্ছে না কেন?

৫) নতুন আইজিপি দায়িত্ব নেয়ার পরও যে দেশের নানা জায়গায় পুলিশের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ সংবাদ মাধ্যমে আসছে, সেটি উল্লেখ করা হয়নি। সংবাদে আসে না, এমন অনেক ঘটনাও তো থাকতেই পারে। ভিডিওতে বলা হয়েছে, দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে কাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না।

কক্সবাজারে মেজর সিনহা নিহতের আগে ওসি প্রদীপ ঠিকই তার অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেটা কি পুলিশের উচ্চ পর্যায়ে কেউ জানতেন না? যদি জেনেও তাকে ছাড় দেয়া হয়ে থাকে সেটা যেমন অপরাধ, এত বড় অপরাধীর কথা পুলিশের না জানাও প্রমাণ করে তাদের অজান্তেই বাহিনীতে নানা কিছু হতেই পারে৷ কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন বাংলাদেশে প্রদীপের মতো ওসি একজনই ছিলেন বা আছেন?

গত বছর ৩০ মে আইজিপিকে পাঠানো এক চিঠিতে ডিএমপি কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম অভিযোগ করেন, তাকে পুলিশের কেনাকাটায় ‘পার্সেন্টেজ' দেয়ার প্রস্তাব করেছেন তারই অধীনস্থ যুগ্ম কমিশনার মো. ইমাম হোসেন৷ এক সপ্তাহ পর সে সংবাদ যখন গণমাধ্যমের নজরে আসে, তখনও সেই যুগ্ম কমিশনারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং সংবাদ প্রকাশের অভিযোগে পত্রিকার প্রতিবেদককেই পুলিশ কার্যালয়ে ডেকে পাঠানো হয়।

অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ডয়চে ভেলে
অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Böll

এই খবরের পর টিআইবি তো বটেই, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারাও পুলিশের শীর্ষ পর্যায় দুর্নীতিতে আক্রান্ত বলে তাদের আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেন। তারপরও এত জোর দিয়ে 'পুলিশে দুর্নীতি নেই' বা 'দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পেলেই দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়' কিভাবে বলছেন?

৬) আল জাজিরার প্রতিবেদনের চরিত্র হারিস আহমদকে 'জনৈক ব্যক্তি' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার নাম নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ বাহিনী? 'এই ব্যক্তি হারিস আহমেদ না' তা নিশ্চিতভাবে জানা গেলে এটা অনেক বড় তথ্য। আর 'এই ব্যক্তি হারিস আহমেদ' সেটাও পুলিশের পক্ষে বলা অনেক বড় তথ্য। কিন্তু এটা তারা বারবার এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন?

৭) 'ওই ব্যক্তি' আদৌ এ ধরনের বক্তব্য প্রদান করেছেন, নাকি 'কাট-কপি ও পেস্ট' করে এ বক্তব্য তৈরি করা হয়েছে, তা পুলিশ নিশ্চিত না। সন্দেহের উপযুক্ত কারণ থাকলে এ প্রশ্ন তোলাই যেতে পারে। কাট-কপি বা ডিপফেক বোঝার জন্য উন্নত প্রযুক্তি আমাদের কাছে না থাকলেও পুলিশের কাছে থাকার কথা।

কিন্তু এমন সন্দেহের পেছনে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ না দেখিয়ে যেটা নিশ্চিত না সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিষয়বস্তু হালকা করার উদ্দেশ্য কী?

৮) ভিডিওতে বলা হয়েছে, প্রাথমিকভাবে অনুসন্ধানের মাধ্যমে 'ওই ব্যক্তি বিদেশে অবস্থান করছেন' বলে তারা জানতে পেরেছেন। অথচ কোনো অনুসন্ধান ছাড়াই পুলিশের ওয়েবসাইটের মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টে গেলেই হারিস আহমেদের নাম পাওয়া যাচ্ছে। ঠিক কী ধরনের অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে? কোনো তদন্ত কমিটি কি হয়েছে এ বিষয়ে? কী দায়িত্বে রয়েছেন? কোন কোন অভিযোগ সামনে রেখে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে?

৯) এয়ারপোর্ট পুলিশসহ নানা কিছু ব্যাখ্যা করে বলা হলো 'জনৈক ব্যক্তির' বর্তমান পুলিশ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।

কিন্তু ‘জনৈক ব্যক্তি' কিভাবে পলাতক আসামি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে নির্বিঘ্নে আসা-যাওয়া করছেন, সে ব্যাপারে এই ভিডিওতে পুলিশেরও কোনো মন্তব্য নেই।

পুলিশের শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও তিনি এয়ারপোর্ট দিয়েই বাংলাদেশে ঢুকলেন, ঘুরলেন, বিয়েতে যোগ দিলেন? তাহলে পুলিশ তখনই 'জনৈক ব্যক্তির' বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলো না কেন? এটা কী পুলিশের গোয়েন্দাদের ব্যর্থতা, নাকি অন্য কিছু? এমন আর কোন কোন পলাতক আসামি পুলিশের ‘অজান্তে' দেশে ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছেন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতেই পারে৷

১০) 'জনৈক ব্যক্তির' জাল পাসপোর্ট, জাল সার্টিফিকেট ইত্যাদি তৈরি, বিদেশে তাকে অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে সহায়তা, অবৈধ লেনদেন ইত্যাদি ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তার সহযোগিতা থাকার অভিযোগ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ ব্যাপারে কি সুনির্দিষ্ট কোনো তদন্ত চলছে? ভিডিওতে এ বিষয়টিও এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

দুর্নীতি মোকাবিলায় পুলিশের অনেক কর্মকাণ্ড সংবাদ মাধ্যমেও এসেছে৷ মাদক ব্যবহার, চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত অনেক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, এমনও আমরা জানি৷ কিন্তু পাশাপাশি অনেক সংবাদের মতো টাকার দাবিতে সিলেটে পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হানের হত্যার অভিযোগের বিষয়টিও আমরা জানি৷

ফলে প্রতিবেদনের পেছনে শুরুতেই উদ্দেশ্য খোঁজা শুরু করলে অনেকে তদন্তহীন প্রতিবাদের পেছনেও উদ্দেশ্য খুঁজতে শুরু করতে পারেন৷ তাতে পরিস্থিতি ঘোলা গেলেও সমস্যাটার সমাধান কি হবে?