‘‘সংগীতই আমার ধর্ম’’
২৬ জুলাই ২০১৩ফ্রাঙ্কফুর্টে বসবাসকারী সুইস সংগীত বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানী মারি স্পিশিগার বলেন, ‘‘সংগীত ও ধর্ম একই শেকড় থেকে আসা৷ এ দুটিই এমন এক অনুভূতি জাগায়, যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন৷ এটি এমন এক অভিজ্ঞতা যা নিত্যদিনের সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায়৷'' ভক্তরাও তাঁর গানের সেই আনন্দ স্রোতে অবগাহন না করে পারেন না৷ অবশ্য তিনি জোর দিয়েই বলেন, ‘‘আমি কিন্তু ধার্মিক নই৷''
যেন স্বর্গীয় দূতের ডানা ঝাপটানো
সংগীতের আধ্যাত্মিক শক্তি মানব ইতিহাসের সেই শুরু থেকে আজ পর্যন্ত বিরাজমান৷ এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও তবলচি ও বাদকরা আগের মতো একই ধরনের ঢাকঢোল ও বাঁশি বাজান৷ অবশ্য আদিবাসী মানুষের কাছে সংগীত আজও কোনো বিনোদন নয়, বরং এর মাধ্যমে তারা ঈশ্বরের সান্নিধ্য পেতে চেষ্টা করেন৷
খ্রিষ্ট ধর্মেও সংগীত সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে৷ গ্রেগরিয়ান গানের পালা থেকে বাখ সংগীত হয়ে গসপেল পর্যন্ত সংগীতের সব ধারাতেই উঠে এসেছে ধর্মীয় কর্মকাণ্ড, উৎসব ও ধ্যান ধারণা৷
পাডেরবর্ন-এর সংগীত মনোবিজ্ঞানী হাইনের গেমব্রিস তাই এ বিষয়টির উপর জোর দিয়ে বলেন, ‘‘সংগীত যেন স্বর্গীয় দূতের ঝাপটানো ডানা, যা আমাদের মন ছুঁয়ে যায়৷ যার মাধ্যমে আমরা বিশাল কোনো কিছুর উপস্থিতি অনুভব করতে পারি৷ আর এই বিশালত্ব আমাদের নিজস্ব গণ্ডি থেকে বের করে আনতে পারে, ছড়িয়ে দিতে পারে সারা বিশ্বে৷''
ধর্ম ছাড়াই আধ্যাত্মিকতা
ধর্মনিরপেক্ষ পশ্চিমা জগতে সংগীতের ভূমিকা অনেকটা পশ্চাত্পটে চলে এসেছে৷ এককালে উপাসনা ও ধর্মীয় রীতি-নীতির মাধ্যমে মানুষের মনে যে অনুভূতির সঞ্চার হতো, তা আজ নানা ধরনের কনসার্টের মাঝে খুঁজে পেতে চেষ্টা করে তারা৷ আজকের তরুণদের কাছে তারকা শিল্পীরাই যেন আধ্যাত্মিক জগতের সাধু, সন্ত৷ তাদের সংগীতেই আনন্দ ও সান্তনা খোঁজে তারা৷
সংগীত বিশেষজ্ঞ মারিয়া স্পিশিগার বলেন, ‘‘সংগীতের সুরে স্বর্গীয় সুধার আবেশ মানুষ খুব সহজে পায় না৷ নিজের সংস্কৃতির ভাণ্ডার থেকে এটি খুঁজে নিতে হয়৷ অনেকের কাছেই সংগীতের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব৷ তারা এর মাঝে জীবনের অর্থ ও যৌক্তিকতা খোঁজে৷ আবার কেউ কেউ সংগীতের মাধ্যমে ধর্মীয় আকাঙ্খা মেটায়৷''
রয়েছে ধ্বনির উন্মাদনা
একই মত পোষণ করেন ৩৬ বছর বয়সি এলিজাবেথ ডিক-এর মতো সংগীত ভক্তরা৷ তিনি বলেন, ‘‘আগে আমি ‘এনিগমা' পছন্দ করতাম৷ ব্যান্ডের কোমল সুরের গানগুলো আমার কাছে পুরোপুরি স্বর্গীয় বলে মনে হতো৷ আমার এমন এক অনুভূতি হতো, যেন আমি অন্য জগতে ভাসছি৷'' এখন অবশ্য তিনি রক কনসার্টে বেশি যান৷ এ সম্পর্কে এলিজাবেথ বলেন, ‘‘এক্ষেত্রে কারো ভাবা ঠিক হবে না যে, সেখানে আধ্যাত্মিক কিছু আছে৷ কিন্তু শত শত ভক্ত যখন আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে, তখন নিজেকেও তাদের সাথে মিলিয়ে দিতে ইচ্ছা করে৷ তখন আমি যেন মোহমুগ্ধ হয়ে পড়ি৷''
টেকনো পার্টিগুলিতেও এই রকম আবহ সৃষ্টি হয়৷ সেখানে তরুণরা ছন্দের তালে তালে এক উন্মাদনায় দুলতে থাকে৷ গবেষণায় দেখা গেছে, এটি স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে সারা শরীরেই প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে৷ ফলে কয়েক ঘণ্টা নাচতে থাকলে সবাই একরকম মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে৷
ধর্মের বিকল্প সংগীত
এভাবে শুধু সংগীত তারকারাই নয়, বরং ডিস্কজকি বা ডিজেরাও এক ধরনের ধর্মীয় মডেল বা আদর্শে পরিণত হচ্ছেন৷ তরুণরা এখন এই সব শিল্পীকে অনুকরণ করে নিজেদের গড়ে তুলতে চাইছে৷ তাই তো এই ধারার সাথে তাল মিলিয়ে মার্কিন শিল্পী ‘পিঙ্ক' ‘গড ইজ এ ডিজে' শিরোনামের গান করে দারুণ হিট করেছেন৷
পছন্দের তারকা বা শিল্পীর কনসার্টগুলোতে ভক্তরা একে অন্যের সঙ্গে এক ধরনের একাত্মতা অনুভব করেন৷ তাঁদের চালচলন, পোশাক-আশাক ও অলংকার একই রকমের হয়৷ এক ধরনের ফ্যানগ্রুপ গড়ে তোলেন তাঁরা৷ আর এই ভাবে সংগীতের অন্যান্য ধারার অনুরাগীদের কাছ থেকে সচেতনভাবেই নিজেদের আলাদা করতে চান ভক্তরা৷