1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আবেগ চাইছে মেসিকে, ফুটবল-বুদ্ধি বলছে ইউরোপ জিতবে

প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়
১৮ নভেম্বর ২০২২

ফুটবলে ইউরোপের কাছে কি ক্রমশ হেরে যাচ্ছে ল্যাটিন অ্যামেরিকা? আমাদের আবেগ যতই মেসি-নেইমারের সঙ্গে থাকুক না কেন, ইউরোপই এখন ফুটবলের প্রধান শক্তি৷

https://p.dw.com/p/4JkJQ
বিশ্বকাপ আয়োজনে প্রস্তুত কাতার
কাতারে রোববার বিশ্বকাপ শুরু হচ্ছেছবি: Marko Djurica/REUTERS

ফেলে আসা গত চারটে বিশ্বকাপের দিকে তাকান৷ যে ব্রাজিল, অর্জেন্টিনার মতো ল্যাটিন অ্যামেরিকার দলগুলিকে আমরা গলা ফাটিয়ে সমর্থন করি, যাদের জেতা-হারার সঙ্গে আমাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা জড়িয়ে যায়, তারা কেউ বিশ্বকাপ জিততে পারেনি৷  যে ব্রাজিল পাঁচবার বিশ্বকাপ জিতেছে, যে ম্যারাডোনার খেলা দেখে আমরা আর্জেন্টিনার সমর্থক হয়েছি, তারা বিশ্বকাপ জেতা দূরস্থান, ফাইনালেই উঠতে পারছে না৷ গতবার তো তারা সেমিফাইনালেও ওঠেনি৷

যারা দীর্ধদিন ধরে ফুটবল মাঠে শিল্পের ফুল ফুটিয়েছে, তারা কেন এভাবে পিছিয়ে পড়ছে, আর দ্রুতগতিতে উঠে এসেছে ইউরোপ? তাদের ফুটবল অনেক সময়ই দৃষ্টিনন্দন নয়, মেশিনের মতো লাগে, কিন্তু হিসাব কষে, পরিকল্পনা করে, তারা দক্ষিণ অ্য়ামেরিকার বিখ্যাত স্কিলকে পর্যুদস্ত করছে৷ এখন তো দক্ষিণ অ্যামেরিকাও ইউরোপীয় ঘরানার ফুটবলের মধ্যে ঢুকে পড়ছে৷

কেন এই অবস্থা? এটা বুঝতে গেলে আমাদের একটু ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ের মতো দেশগুলির দিকে তাকাতে হবে৷ ব্রাজিলের কথাই বলি৷ আমি সেখানে গিয়েছি৷ গিয়ে দেখে এসেছিলাম, কীভাবে ১৪০টার বেশি ফুটবল একাডেমি ফুটবলারদের তুলে আনত৷ এখন ব্রাজিলকে দেখুন৷ গোটা ৪০ একাডেমি আছে৷ বেশিরভাগই ধুঁকতে ধুঁকতে চলছে৷ দশ বছর আগে দেখেছি, গরিব দেশের মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে বলছে, আমাদের ভাত চাই, ফুটবলের দরকার নেই৷ অথচ, ব্রাজিল মানেই তো আমাদের কাছে ফুটবল৷ ব্রাজিল মানেই তো আমাদের কাছে পেলে, গ্য়ারিঞ্চা, জিকো, সক্রেটিস এবং এখন নেইমার৷

সেই ব্রাজিলে অর্থের অভাবে ফুটবলে পিছিয়ে পড়লো? সেখান থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে ফুটবলাররা? চলে যাচ্ছে ইউরোপের দেশে৷ দশ-বারো বছর বয়সে৷ সেখানে তাদের প্রশিক্ষণ হচ্ছে৷ তাদের বড় করে তোলা হচ্ছে৷ তাহলে কোন ঘরানা তারা শিখবে? অবশ্যই ইউরোপের ঘরানা৷ এই দেখুন না, মেসি, নেমাররা সবাই ইউরোপের ক্লাবে খেলে৷ সেখানে তাদের ইউরোপীয় ঘরানার ফুটবল খেলতে হয়৷ তাহলে ব্রাজিল-অর্জেন্টিনার সেই ফুটবল-শিল্প মাঠে দেখা যাবে কী করে? ম্য়ান টু ম্যান মার্কিং, অঙ্ক কষে ফুটবল, পাস অ্যান্ড গো-র তত্ত্ব সেখানেও ঢুকে পড়ে৷ স্কিল, টাচ এসব ছেড়ে ফুটবল মেশিনারির মধ্যে ঢুকে যাও৷

এরপরেও যে মেসির মতো কিছু ফুটবলার মাঠে শিল্পের ফুল ফোটান, যা দেখতে ভালো লাগে৷ মেসি আমার প্রিয় ফুটবলার৷ বাঁ পায়ে খেলা মহান ফুটবলার৷ আমি বাঁ পায়ে খেলা একজন সামান্য ফুটবলার হিসাবে তাঁকে অসীম শ্রদ্ধা করি, সম্মান করি৷ কিন্তু মেসি একা কী করবেন? তাকে থামানোর জন্য অঙ্ক কষে ফেলেছে ইউরোপের দলগুলি৷ ফুটবল বিজ্ঞান তাদের করায়ত্ত্ব৷ তাদের দর্শন হলো, দৃষ্টিনন্দন ফুটবলের দরকার নেই৷ একটা গোল কর৷ সেই লিড ধরে রাখ৷ জিততে না পারলে ড্র কর৷ খেলাটাকে টাই ব্রেকারে নিয়ে যাও৷

ইউরোপের কাছে অর্থ আছে৷ তারা কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলারদের ছোটবেলা থেকে তৈরি করছে৷ নিজেদের দলে নিচ্ছে৷ একবার দেখুন, ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দলে কীভাবে উঠে এসেছেন কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলাররা৷ ফ্রান্সের এমবাপে থেকে শুরু করে একগুচ্ছ নাম নিতে পারি৷ কেন? ওই অর্থের জন্য৷ ল্যাটিন অ্যামেরিকা, আফ্রিকার দেশগুলোর কাছে অর্থ নেই৷ তাই তারা চলে যাচ্ছে ইউরোপে৷ ইউরোপে এখন ফুটবল হলো অন্যতম বড় ব্যবসা৷ আর তাদের প্ল্যানিংয়ের কোনো তুলনা নেই৷ তারা সমানে ফুটবলার তুলে আনছে৷ এবার স্পেনকে দেখুন৷ সব বাচ্চা বাচ্চা ফুটবলার নিয়ে টিম হয়েছে৷ তারা চমকে দিতে পারে৷

ব্রাজিলে নেইমার আছেন, আর্জেন্টিনায় মেসি আছেন৷ কিন্তু তারপরেও কি এই বিশ্বকাপে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা জিততে পারবে? আমার আবেগ বলছে, আর্জেন্টিনা জিতুক৷ এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা  ফুটবলার মেসিকে স্বমহিমায় যেন দেখতে পাই৷ এটাই মেসির শেষ বিশ্বকাপ৷ যেমন স্কিল, তেমনই ভদ্র মানুষ৷ আর্জেন্টিনা টিমও খারাপ নয়৷ টিম ভালো না হলে একা মেসি কিছু করতে পারবেন না৷ আপনারা সিআর সেভেনকে দেখুন৷ ক্লাব ফুটবলে কিংবদন্তী ফুটবলার হয়েও দেশকে বিশ্বকাপ জেতাতে পারলেন না৷ মেসিও এখনো পর্যন্ত পারেননি৷ তবে মেসি এবার জীবনের সেরা খেলা খেলতে চাইবেন৷ কারণ, ক্লাব ফুটবলে সেরা হলেও বিশ্বকাপে সেরা হতে না পারার যন্ত্রণা ভয়ংকর৷

প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, ভারতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক
প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, ভারতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়কছবি: IANS

কিন্তু আমার ফুটবল বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা বলছে, ইউরোপের কোনো দল বাজিমাত করবে৷ ফ্রান্স, ইংল্য়ান্ড, স্পেন, জার্মানি-সহ ইউরোপের দেশগুলো অঙ্ক কষে মাঠে নামবে৷ মেসিদের থামানোর অঙ্ক৷ তাদের পাস অ্যান্ড গো, তাদের প্রতিটি ম্যাচে সাত-আট কিলোমিটার দৌড়, ম্যান টু ম্যান মার্কিং, উঠেনেমে সারা মাঠজুডে় খেলে যাওয়া, মাঝেমধ্যে স্কিলের ঝলক, তার সঙ্গে মেসিরা বল ধরলেই তাদের স্কিল বিফল করে দেয়ার রণকৌশল সব তাদের ঝুলিতে থাকবে৷

তারপরেও মেসিরা সফল হতেই পারেন৷ কারণ, তারা মহান প্লেয়ার৷ তবে সেই কাজটা খুব শক্ত৷ তাই আমরা যতই চাই না কেন, পরপর পঞ্চমবারও যদি বিশ্বকাপ ল্যাটিন অ্যামেরিকার কোনো দেশের হাতে না ওঠে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই৷

শেষে একটা কথা বলি, ভারত, বাংলাদেশের মতো দেশের ফুটবলারদের  দেখে দুঃখ হয়৷ তাদের স্কিল আছে, টাচ আছে, যেটা নেই তা হলো অর্থ, ঠিকভাবে ফুটবলার হওয়ার মতো বেড়ে ওঠা৷ পিকে, চুনী, বিজয়নদের স্কিল কম ছিল? তারপরেও ভারতীয় ফুটবলের দৈন্যদশা ঘুচলো না৷ আমাদের ফুটবলে পয়সা নেই৷ ক্রিকেটে আছে বলে সবাই সেদিকে ঝোঁকে৷ আমাদের ফুটবলাররা পড়ে থাকেন অন্ধকারে৷ ইউরোপের নজর আফ্রিকার দিকে, ল্যাটিন অ্যামেরিকার দিকে পড়ে৷ ক্লাবগুলি সেখান থেকে বাচ্চা ফুটবলারদের সংগ্রহ করে৷ বৈজ্ঞানিকভাবে তারা ফুটবলার হিসাবে বেড়ে ওঠে৷ আমরা পিছিয়ে পড়ি৷ ক্রমাগত পিছোতেই থাকি৷ বিশ্বকাপ এলে অন্যদের খেলা দেখে আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়৷

(সাক্ষাৎকার ভিত্তিক অনুলিখন)

প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, ভারতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক, অর্জুন পুরস্কারপ্রাপ্ত৷