আকিল ইব্রাহিম: ত্রাস ও স্বাধীনতা
১ আগস্ট ২০১১আকিল ইব্রাহিম লাজিম যখন নাইন-ইলেভেনের খবরটা পান, তখন তাঁর নিজের বিয়ের আয়োজন চলেছে৷ বসরার তরণ দাঁতের ডাক্তার আকিল৷ বাগদত্তার সঙ্গে বসে বিয়ের খুঁটিনাটি ঠিক করছেন, চোখে পড়ল টিভি'তে সুদূর মার্কিন মুলুকের এক আশ্চর্য দৃশ্য৷ খোদ নিউ ইয়র্কে জেটপ্লেন গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে সুউচ্চ টাওয়ারে৷ আগুন জ্বলছে৷ মানুষজন ঝাঁপ দিচ্ছে৷ টাওয়ার ভেঙে পড়ছে৷ ধুলোর ঝড় বেয়ে আসছে রাজপথ ধরে৷
দ্বন্দ্ব
আকিল তো প্রথমে ভেবেছিলেন এটা কোনো মার্কিন থ্রিলার ছবি৷ পরে ভাবলেন, মানবসভ্যতার অন্ত ঘটছে৷ কিন্তু নিজের যে অনুভূতিটা ৩৫ বছর বয়সী আকিলের আজও মনে আছে, সেটা হল: এই অভাবনীয় আক্রমণের শিকার যে সব নিরপরাধ মানুষ, তাদের জন্য এক আশ্চর্য মমতা৷ অথচ সেই আক্রমণ যারা চালিয়েছে, তারা তো আকিলের মতোই মুসলমান৷ আকিল এই দ্বন্দ্বে অভ্যস্ত ছিলেন না৷
১১ সেপ্টেম্বরের রাতে শহরের পথে পথে হঠাৎ নিরাপত্তা বাহিনী এবং শাসক বাথ পার্টির সদস্যদের বন্দুক হাতে টহল দিতে দেখেন আকিল - যেন ইরাকই পরবর্তী আক্রমণের লক্ষ্য হতে পারে৷ বিয়ের দিনগুলোতেও আকিল যতো না অভিনন্দনবার্তা পেয়েছেন, তার চেয়ে বেশি নাইন-ইলেভেনের খবর শুনেছেন৷ কিছুদিনের মধ্যেই বোঝা যায় যে, নাইন-ইলেভেনের ফলশ্রুতি হিসেবে ইরাককেও আরো একটি যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হবে৷ মার্কিন সরকার সাদ্দাম হুসেনের বিরুদ্ধে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র মজুদ করার অভিযোগ তোলে৷ সেই সঙ্গে আল-কায়েদার সঙ্গে সংযোগেরও অভিযোগ ছিল৷
২০০৩ সালের ১৯ মার্চ৷ ইরাক যুদ্ধের শুরু৷ এবারও আকিলের দ্বিধাবিভক্ত অবস্থা৷ বহু ইরাকির মতো তিনিও স্বদেশের উপর এই আক্রমণে সুখী ছিলেন না৷ অপরদিকে সাদ্দাম হুসেনের পতনের প্রত্যাশা ছিল৷ যা ঘটতে মাত্র ২২ দিন সময় লাগে এবং ইরাকে হর্ষ-উল্লাসের বন্যা বয়ে যায়৷ অপরদিকে বসরার রাস্তায় দখলদারী বিদেশি সৈন্যদের দেখে অন্যান্য অনেক ইরাকির মতোই খুশী হতে পারেননি আকিল৷ অথচ সেই নতুন পাওয়া স্বাধীনতার স্বাদ, নিজের মনোভাব প্রকাশ্যে এবং নির্ভয়ে ব্যক্ত করার এই অভূতপূর্ব স্বাদ ভুলতে পারেননি আকিল৷ পেশাগতভাবেও: বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর চাকরিটাও থাকল, আবার নিজের চেম্বারও খুলতে পারলেন আকিল, সাদ্দাম এবং তার পেটোয়াদের আমলে যা দুঃসাধ্য হতো৷
স্বাধীনতার মূল্য
কিন্তু স্বাধীনতার মূল্য দিতে হয়৷ ইরাকিদের তাদের সদ্যলব্ধ স্বাধীনতার মূল্য দিতে হয়েছে বছরের পর বছর চরম বিশৃঙ্খলা, শিয়া-সুন্নি রক্তাক্ত সংঘাত এবং একের পর এক সন্ত্রাসী আক্রমণ সহ্য করে৷ ‘‘এ তো আমাদের স্বপ্নের স্বাধীনতা নয়,'' বলেছেন আকিল৷ এ কেমন স্বাধীনতা, যা হাজার হাজার ইরাকির প্রাণ নিয়েছে, দেশকে নৈরাজ্যে ডুবিয়ে দিয়েছে? ২০০৬ সালে আকিলের এক আত্মীয় অপহৃত হন৷ তার খোঁজে আকিল মর্গে গিয়ে দেখেন লাশের পর লাশ, পচনের গন্ধ৷ তাঁর সেই আত্মীয়ের লাশ কিন্তু কোনোদিনই খুঁজে পাওয়া যায়নি৷
তাই আজ নাইন-ইলেভেনের ছবি দেখে আকিল ভাবেন: এদেশেও তো মানুষেরা, শিশুরা এই যুদ্ধ, সহিংসতা এবং সন্ত্রাসের পরিবেশেই বেঁচে আছে, বড় হচ্ছে৷ তাদের সকলের মধ্যেও ভয় দানা বেঁধে আছে৷ নয়তো আকিল প্রতিদিন তাঁর দুই ছেলেমেয়েকে ব্যক্তিগতভাবে স্কুলে পৌঁছে দেন কেন৷
প্রতিবেদন: মুনাফ আল সাইদি/অরুণ শঙ্কর চৌধুরী
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ