‘অর্থায়নের অভাবে দাঁড়াতে পারছে না বিমান’
২০ ডিসেম্বর ২০১৬ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী অবশ্য তারপরও বিমানের ভবিষ্যত নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন৷ তাঁর সময়ে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে – এমনটি দাবি করে রাশেদ খান মেনন, বলেন, ‘‘আমি আসার পরে এ পর্যন্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বেশ কয়েকটি প্লেন কিনেছে৷ বেশ কয়েকটি রুটও চালু করা হয়েছে৷ আমি আশা করি, ভবিষ্যতে বিমান শক্তভাবে উঠে দাঁড়াবে৷''
ডয়চে ভেলে: বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ তো নিয়মিতই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে৷ এটা কেন?
রাশেদ খান মেনন: আপনারা জানেন যে, বিমানের অনেক সমস্যা এবং সেটা বহুদিন থেকেই আছে৷ এর মধ্যে বেশ কিছু সমস্যা অতিক্রম করা গেছে৷ কিন্তু তারপরও শুধু রক্ষণাবেক্ষণ নয়, অনেকক্ষেত্রেই এখনো সমস্যা রয়ে গেছে৷
দীর্ঘদিন ধরে তো বিমান একটি লোকশানি প্রতিষ্ঠান৷ আচ্ছা, বিমান আসলে কেন লাভ করতে পারে না?
বিমান কিন্তু গত দু'বছর লাভের মুখ দেখেছে৷ বিমানের বহরে এতদিন পুরনো বিমান ছিল৷ তাই যে এয়ারবাসগুলো ছিল, সেগুলো প্রচণ্ড পরিমাণ তেল খেত৷ এগুলো শর্ট হল ছাড়া লং হলে যেতে পারত না৷ ফলে বিমানের অনেক রুট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ বেশি জ্বালানি খাওয়ার কারণে বিমান লসে ছিল, মানে লোকশান করছিল৷ এখন সেটা অতিক্রম করে আমরা ইতিমধ্যে সেই লস কাভার করে লাভের জায়গায় পৌঁছে গেছি৷ আমি আশা করি, আগামী দিনে বিমান আরো ভালো করে লাভের মুখ দেখতে পারবে৷
এয়ারলাইন্স মার্কেটের অধিকাংশই এখন বিদেশিদের দখলে৷ তা বিমান কেন এটা দখলে নিতে পারছে না?
বিমানের যে অর্থনৈতিক ভিত্তি, তার মধ্যে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এটাকে কর্পোরেশন থেকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করে ফেলা হলো৷ অথচ এটা অর্থায়ন করার জন্য যে পুঁজির প্রয়োজন, সেই পুঁজি পাওয়া যায়নি৷ ফলে অন্য এয়ারলাইন্সগুলো যেভাবে ব্যবসা করতে পারে, বিমান সেভাবে পারে না৷ যেমন ধরুন এমিরেটস৷ এরা শেখদের কাছ থেকে যে সহযোগিতা পায়, সেটা তো পায়ই, পাশাপাশি জ্বালানি তেল কিনতে তাদের যদি দু'টাকা লাগে, তাহলে বিমানের লাগে ১০ টাকা৷ আবার বিমানগুলো পুরোনো হওয়ার কারণে জ্বালানিও লাগে বেশি৷ এ কারণে বিমানে এটা হয়নি৷ আমি আসার পর এ পর্যন্ত বিমানে কয়েকটি প্লেন কেনা হয়েছে, বেশ কয়েকটি রুট চালু করা হয়েছে৷ আমি আশা করি, ভবিষ্যতে এটার সমাধান করা সম্ভব হবে৷
বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি চাইলেই দেয়া হয়৷ আগে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ বিদেশি কোনো এয়ারলাইন্সকে অনুমতি দেয়ার আগে বিমানের সঙ্গে আলোচনা করত৷ কিন্তু এখন আর সেটা করে না৷ এই আলোচনা না করা কি দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দূরত্ব , নাকি অন্য কিছু?
সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ এখনো বিদেশি কোনো এয়ারলাইন্সকে ফ্রিকোয়েন্সি দিতে গেলে বাংলাদেশ বিমানের সঙ্গে আলোচনা করে৷ আর ফ্রিকোয়েন্সির বিষয়টি তো বিমানের কিছু না, এগুলো অনেক আগে থেকেই নির্ধারিত৷ এখানে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো এ সব ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করতে পারলেও, বিমান সেটা পারে না৷ সব জায়গায় যাওয়ার ক্ষেত্রে যে পরিমাণ উড়োজাহাজ বিমানের দরকার, সেটা তাদের নেই৷ তবে এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন যে, বিমান পারছে না বলে তো আর অন্যদের আটকে রাখা যাবে না৷ তাছাড়া এই ফ্রিকোয়েন্সি দেয়া হয় সরকারের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে৷ বাংলাদেশে তো যাত্রী বাড়ছে, কার্গো বাড়ছে, এটাকে পূরণ করতে গেলে তো কোনো না কোনো এয়ারলাইন্সকে ব্যবহার করতেই হবে, তাই না? আসলে সেই জায়গা পূরণ করতে বিমান পারছে না৷ আর যতদিন তারা সেটা পূরণ করতে না পারবে, ততদিন এই কম্পিটিশনে বিমান পিছিয়েই থাকবে৷
কোনো প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেয়ার পরে সেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ রাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিপুল পরিমাণ টাকা বকেয়া পড়ে আছে৷ সর্বশেষ ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স বন্ধ হওয়ার পর, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে তাদের বিপুল পরিমাণ টাকা বকেয়া রয়েছে বলে জানা গেছে...৷
ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান৷ তাদের কাছে যে বকেয়া রয়েছে, সেটা উদ্ধারের জন্য তাদের যে এয়ারক্রাফটগুলো আছে সেগুলো জিম্মায় নিলে আমাদের টাকা আদায় সম্ভব হবে বলে আমার ধারণা৷
অভ্যন্তরীণ রুটে আমাদের দেশে ভাড়া অনেক বেশি৷ অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে খুব অল্প টাকায় অভ্যন্তরীণ রুটে ভ্রমণ করা যায়৷ সরকারিভাবেই সে দেশে ভাড়া কমিয়ে দেয়া হয়েছে৷ তাহলে আমরা কেন ভাড়া কমাতে পারছি না?
এ কথা ঠিক নয় যে, বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ রুটে ভাড়া অনেক বেশি৷ এখন সর্বনিম্ন দুই হাজার বা আড়াই হাজার টাকায় ভ্রমণ করা যায়৷ তবে একটা জিনিস সবাই ভুল করেন যে, আন্তর্জাতিকভাবেই একটা জিনিস চালু আছে৷ আপনি যদি ১০ দিন আগে টিকিট কাটেন তাহলে একরকম দাম পাবেন, আপনি যদি পাঁচ দিন আগে কেনেন তাহলে এক রকম দাম পাবেন৷ আর যদি শেষ মুহূর্তে কাটেন তাহলে আপনাকে অনেক বেশি দাম দিতে হবে৷ এটা তো সবাই অনুসরণ করে, তাই বিমানও অনুসরণ করে৷ এটার জন্য বলা যাবে না যে, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ভাড়া খুব বেশি৷
আপনি মন্ত্রী হওয়ার পর বিমানকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
আমরা বহর বাড়াচ্ছি৷ সরকারের তরফ থেকে বেশ কিছু বিমান কেনা হচ্ছে৷ এক্ষেত্রে রেগুলার পেমেন্ট যাতে হয়, সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে৷ অভ্যন্তরীণ রুটে যেখানে বিমান ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছিল, সেই আমরা রুটগুলো চালু করেছি৷ আগে যেখানে বিমান যেতই না, এখন সেখানে একটি- দু'টি বা তিনটি ফ্লাইট যাচ্ছে৷ কিন্তু আমাদের অসুবিধে হচ্ছে, আমাদের বহরে বিমান অনেক কম৷ তবে শিগগিরই অভ্যন্তরীণ রুটে আমরা তিনটি বিমান কিনব৷ অন্যদিকে ৭৮৭ ড্রিমলাইনার বিমানটিকেও আমরা আনার চেষ্টা করছি৷ আশা করি, ২০১৯ সালের মধ্যে বিমানের বহর অনেকটা বৃদ্ধি পাবে৷ তখন এই রুটগুলোকে আমরা বাড়াতে পারব৷ ইতিমধ্যে আমরা ঢাকা-দিল্লি, ঢাকা-শ্রীলংকা, ঢাকা-মালদ্বীপ, ঢাকা-গুয়াংজু রুটে বিমান বাড়ানোর চেষ্টা করছি৷ এর বাইরেও আমরা অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছি৷ অন্য বিমানের সঙ্গে আমরা কোড শেয়ারিং করতে চাই৷ ইত্তেহাদের সঙ্গে আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে৷ বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গেও আলোচনা চলছে৷ এটা করা গেলে আমাদের ক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে৷ এর সঙ্গে সঙ্গে বিমানের ম্যানেজমেন্টকে আমরা আরো আধুনিক করার চেষ্টা করছি৷
রক্ষণাবেক্ষণের জায়গায় আপনার গুরুত্ব কতখানি?
স্বাভাবিকভাবেই রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া কোনো বিমান চলতে পারে না৷ এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷
বিমানের যে অভ্যন্তরীণ সমস্যা আছে, যেমন ফ্লাইট বিলম্ব হওয়া....তার কি কিছু করছেন আপনারা?
এগুলো আগের তথ্য৷ এখন আন্তর্জাতিক রুটের ৭৯ শতাংশ ক্ষেত্রে বিমান শিডিউল বহাল রেখে চলে৷ এটাই এখন স্ট্যান্ডার্ড৷ আপনি যদি সবচেয়ে ভালো এয়ারলাইন্সের কথাও ধরেন, তারাও ৮০-৮২ শতাংশের বেশি শিডিউল বহাল রাখতে পারে না৷ আমাদের এখানে ঝড়-ঝঞ্জা আছে, কুয়াশা আছে৷ এমন নানা কারণে ফ্লাইটে বিলম্ব ঘটে৷ কিন্তু বিমান শিডিউল রাখতে পারে না, এ কথাটা এখন আর সত্য নয়৷
বন্ধু, সাক্ষাৎকারটি কেমন লাগলো? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷