শ্বেত কপোত শান্তির প্রতীক৷ অন্যদিকে কালো কাক, কালো প্যাঁচা সবই নাকি অশুভ! কবে, কে ‘আবিষ্কার' করেছিল এ সব?
অনেকের কাছে ‘কালো' মেয়েও তথাকথিত সাদা বা ফর্সা মেয়ের তুলনায় তুচ্ছ৷ এমনিতেই কন্যা সন্তানের জন্ম আমাদের উপ-মহাদেশের অনেক পরিবারে যেন ‘শোকের বার্তা' বয়ে আনে৷ তার ওপর সেই কন্যার গায়ের রং যদি ‘চাপা', মানে ‘কালো' বা ‘ময়লা' হয়, তবে হতাশার কোনো সীমাই থাকে না৷ জন্মের পরমুহূর্ত থেকেই মেয়েটিকে নিয়ে বাবা-মা-র দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে যায়৷ একটাই দুশ্চিন্তা – ‘মেয়ের বিয়ে দিতে পারবো তো?'
গায়ের রং একটা একেবারেই স্বভাবিক এক প্রকৃতিদত্ত ঘটনা৷ অথচ সমাজে মেয়েদের গাত্রবর্ণ নিয়ে ‘বর্ণবাদ' যুগ যুগ ধরে চলেই আসছে৷ এখনো চলছে কালো মেয়ের প্রতি নিষ্ঠুরতা৷ নইলে চাপা রঙের মেয়েকে জন্মলগ্নেই হত্যা করার মতো ঘটনা এ যুগে ঘটার কথা নয় (ভারতে কিন্তু এমন ঘটনা আজও ঘটছে)৷
গায়ের রং ফর্সা না হলে মেয়েকে বোধ হওয়ার পর থেকেই সইতে হয় গঞ্জনা৷ শুনতে হয় সে ‘সুশ্রী' নয়, ‘কুশ্রী'৷ বলে বলে মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয় এমন ধারণা৷ ফর্সা হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় স্নো-পাউডার, ‘ফেয়ারনেস ক্রিম'-এ নির্ভরশীল হয়ে পড়ে মনন, জীবন৷
‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি'-র বিজ্ঞাপনের কথা মনে আছে? ঐ বিজ্ঞাপনে দেখানো হতো ধীরে ধীরে ফর্সা হওয়ার উপায়৷ উপায় একটাই – ‘ফেয়ারনেস ক্রিম'৷ ফর্সা হলে জীবন বদলে যায়৷ কালো, আত্মবিশ্বাসহীন মেয়েটি ফর্সা হয়, ফর্সা হয়েই হয়ে যায় আত্মবিশ্বাসী, আত্মনির্ভর৷ অথচ এই ‘ফেয়ারনেস ক্রিম' কিন্তু একটা সাধারণ ‘ব্লিচ' ছাড়া কিছুই নয়৷ তা মাখলে ভালো বিয়ে হয়, পুরুষরা পাত্তা দেয়, আত্মসম্মানও বাড়ে? অবাক কাণ্ড!
মেয়ে ‘কালো' হলে সে যেন করুণার পাত্র৷ তাঁর যত যোগ্যতাই থাক, বিয়ে দিতে গেলে পাত্রপক্ষকে যতভাবে সম্ভব খুশি করা সম্ভব করতে হয়৷ কৃষ্ণবর্ণকে বলতে হয় ‘শ্যামলা' বা ‘শ্যামবর্ণা'৷ এভাবে একটু ‘নরম' করে বলে গায়ের রং-টা যদি পাত্রপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায় তাহলে তো ভালোই, না হলে সাধ্য অনুযায়ী যৌতুক দেয়া অবধারিত৷
ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানের পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনগুলো এখনো সমাজে সাদা প্রীতি এবং কালো ভীতি বা কালোর প্রতি বিরাগ বাড়াতে ভূমিকা রাখছে৷ এখনো প্রায় সব ‘পাত্র চাই' বিজ্ঞাপনের শুরুতেই লেখা থাকে – ‘সুশ্রী, ফর্সা....পাত্রীর জন্য সুযোগ্য পাত্র চাই'৷ পাত্রীর শিক্ষাগত যোগ্যতা আসবে শেষ দিকে৷ নাচ-গান বা খেলাধুলায় পারদর্শীতার বিষয়টি তো বলতে গেলে গুরুত্বই পায় না৷ এমনকি খবরের কাগজে নিজের মেয়ের জন্য বিজ্ঞাপন দেয়ার সময়ও মা-বাবা প্রথমে পাত্রীর চেহারা, গায়ের রং, শরীরের গঠনের কথাই উল্লেখ করেন৷ এটা কি হীনমন্যতা নয়?
এমনিতে কিন্তু উপ-মহাদেশের মানুষ ঘরের বাইরে বেশ উদার৷ অন্য দেশের সাদায়-কালোয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে খুবই সোচ্চার৷ অথচ নিজের বা স্বজনের বিয়েতে তাঁদেররই দাবি থাকে ‘ফর্সা বউ'৷ বিয়ের দিন একরকম ‘চুনকাম' করেই কনে সাজে মেয়ে৷ চড়া মেকআপ নিয়ে মঞ্চে বসে৷ কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে বিউটি পার্লারে যায় শুধু একটু ‘ফর্সা রংয়ের সুশ্রী' হতে, যাতে দেখে সবাই বলে, ‘বাহ্, কী নিষ্পাপ, শ্বেত-শুভ্র পরীর মতো বউ হয়েছে!'
আসলে এই সাদা বর্ণ প্রীতি আর কালো বর্ণে বিদ্বেষ আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে আদিকাল থেকে৷ এই ভ্রান্তি, এই অনাচারে বিশ্বাসী মানুষের অভাব নেই আজকের এই তথাকথিত আধুনিক সমাজে৷
ক'দিন আগেও তো বাংলাদেশে ‘বর্ণবাদী‘ আক্রমণের শিকার হলেন এক অভিনেত্রী ও তাঁর স্বামী৷ ছোটপর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী সুমাইয়া শিমুর বর নজরুল ইসলাম একটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থার কান্ট্রি ডিরেক্টর৷ বিদেশে পড়াশোনা করেছেন তিনি৷ কিন্তু তাতে কী? বিভিন্ন অনলাইন সংবাদমাধ্যমে নবদম্পতির ছবিসহ বিয়ের খবর প্রকাশিত হওয়ার পরই শুরু হয়ে গেল আপত্তিকর মন্তব্য৷ শিমুর স্বামীর গায়ের রং, চেহারা নিয়ে ফেসবুকে, অনলাইনে সংবাদের নীচের ‘কমেন্ট বক্স'-এ কুৎসিত মন্তব্য করেছেন অনেকেই৷ তাও ভালো, এখানে বর ছিলেন ‘কালো'৷ কনে যদি কালো হতেন? তাহলে কী হতো একবার ভাবুন!
আমাদের সমাজে এই তথাকথিত ফর্সা রং প্রীতি হয়ত ঔপনিবেশিক শাসনের ‘উপহার' তখনকার৷ শাসক ব্রিটিশদের গায়ের রং দেখেই হয়ত আমাদের মধ্যে এক ধরণের শ্বেতবর্ণ প্রীতি জন্মেছিল৷ তাই হয়ত এখনো অনেকে ভাবেন, ‘রাজা'-র রং সাদা, কালো মানেই ‘প্রজা'৷ এমন বিশ্বাস যেন আমাদের মগজে ঢুকে গেছে৷
যতদিন পর্যন্ত কালোকে অশুভ আর সাদাকে ‘শান্তির প্রতীক' হিসেবে দেখা হবে, সমাজ থেকে বর্ণবিদ্বেষের অন্ধকার কখনোই যাবে না৷ ‘কালো' কেন খারাপ? কেউ খারাপ কিছু করলে কেন তাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়? তালিকার নাম কালোতালিকাই হতে হবে? কেন বিয়ের অনুষ্ঠানে মেয়েরা কালো শাড়ি পরতে পারবে না? কেন শোকের রং-ও কালো? আমরা কি তবে ভুলে গেছি, কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সেই কথাগুলো – ‘কালো আর ধলো বাইরে কেবল/ভেতরে সবার সমান রাঙা'? আমরা কি হীনমন্যতাবোধের কারণে সত্য, সুন্দরের জ্ঞানকে মনন থেকে একেবারে মুছে ফেলেছি?
আপনি কি দেবারতি গুহর সঙ্গে একমত? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷