ধর্ম নিয়ে রাজনীতি
১৩ জুলাই ২০১৬বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার, অর্থাৎ ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা বেআইনি৷ কিন্তু এরপরও ধর্মের ভিত্তিতে দল আছে এখানে৷ বড় রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে ধর্মকে নানাভাবে ব্যবহার করে৷ সেক্যুলার এবং জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রয়েছে ধর্মভিত্তিক অঙ্গ সংগঠন৷
বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের একটি বিএনপি, যারা নির্বাচনের আগে ইসলাম রক্ষার কথা বলে ভোট চেয়েছে৷ তাদের প্রচারণা অনুযায়ী, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দেশে ইসলাম থাকবে না'৷ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ভোটের রাজনীতিকে ‘টার্গেট' করেই সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম' সংযোজন করেন৷ এর পর সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেন ভোটের রাজনীতিকে ‘টার্গেট' করেই৷
এদিকে ভোটের আগে আওয়ামী লীগের বহুল ব্যবহৃত স্লোগান – ‘লা ই লাহা ইল্লাহ, নৌকার মালিক তুই আল্লাহ'৷ দলটি এ-ও প্রচারণা চালায় যে, তারা নির্বাচিত হতে না পরলে সংখ্যালঘুরা দেশে থাকতে পারবে না৷ এছাড়া প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতারা নির্বাচনের আগে হজ বা ওমরাহ করেন, যান মাজারে৷ জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এরশাদ তো কয়েকজন ধর্মীয় পীরকে গুরুর আসনে বসান৷ বিভিন্ন মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন, যান৷
বাংলাদেশের প্রধান দু'টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ইসলামিক ‘উইং' আছে৷ আওয়ামী ওলামা লীগ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন আর জাতীয়তাবাদী ওলামা দল বিএনপির সহযোগী সংগঠন৷
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী যুদ্ধাপরাধের বিচারের কারণে চাপে থাকলেও, তাদের নিয়ে ভোটের হিসাব-নিকাশ হয়েছে৷ এই দলটির মোট পাঁচ থেকে ছয় ভাগ ভোট রয়েছে৷ আর তাতেই তারা জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, কারণ, ভোটের যে হিসাব, তাতে যদি তারা কোনো বড় দলের সঙ্গে জোট করে, তাহলে উভয়ই সুবিধা পায়৷
স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াত প্রথম ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ১০টি আসন পায়৷ এরপর তারা বিএনপির শরিক দল হিসেবে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়৷ ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী যেখানে ১০টি আসন পেয়েছিল সেখানে ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা বিএনপির সঙ্গে জোট করে ১৮টি আসন পায়৷ সেবার তাদের দু'জন নেতা মন্ত্রীও হন৷
এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ক্ষমতাসীন বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সামান্তরাল আন্দোলনে অংশ নেয় জামায়াত৷ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী পায় মাত্র তিনটি আসন৷ সেই সময় বিএনপির সঙ্গে জোট না করায় ভোটে ভরাডুবি হয় তাদের৷ ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আবারো বিএনপির সঙ্গে জোটভুক্ত হয়ে ১৭টি আসন পায় জামায়াত৷
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৩৮ ধারা অনুসারে সাম্প্রদায়িকতা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ হলে রাজনৈতিক দল হিসাবে জাময়াতে ইসলামীর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়৷ বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াত বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল৷ ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক বিধির আওতায় জামায়াত এবং ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ পায়৷
বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মহাজোটে বেশ কিছু ইসলামী দল আছে৷ আর বিএনপির ২০ দলীয় জোটেও জামায়াতসহ ইসলামী রাজনৈতিক দলের প্রাধান্য দৃশ্যমান৷
এর বাইরে ইসলাম ভিত্তিক কিছু সংগঠন বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে বড় ‘ফ্যাক্টর' হিসেবে কাজ করে৷ তার মধ্যে প্রধান হলো, হেফাজতে ইসলাম৷ এই সংগঠনটিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই সমীহ করে চলে৷ হেফাজতের শাপলা চত্বরের সমাবেশকে সমর্থন দিয়েছিল বিএনপি ও জাতীয় পার্টি৷ তারা সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল৷ কিন্তু এখন সরকারই আবার হেফাজতকে কাছে টেনে নিয়েছে৷ হেফাজতের বিরোধিতার কারণেই সরকার নারী নীতি বাস্তবায়ন করছে না৷ ব্লগার ও মুক্তমনাদের সুরক্ষা না দিয়ে উল্টো তাদের বিরুদ্ধেই মামলা করা হয়৷
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ইসলামিক রাজনৈতিক দল আছে ১০টি৷ এগুলো হলো: বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ও খেলাফত মজলিস৷ জামায়াতে ইসলামির নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে আদালতের নির্দেশে৷
এর বাইরে বাংলাদেশে আরো অর্ধশত ইসলামিক রাজনৈতিক দল আছে৷ তারাও ভোটের আগে বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ভিড়ে যায় অথবা বড় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সঙ্গে নেয়৷
বাংলাদেশে কয়েকটি ইসলামি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে আবার জঙ্গিবাদে মদদ দেয়ার অভিযোগও আছে৷ তাছাড়া ভোটের রাজনীতির হিসেবের কারণে মৌলবাদ বা ধর্মীয় প্রচারণা তেমন বিরোধিতার মুখে পড়ে না৷ সবাই চায় তাদের ‘গুডবুকে' রেখে ভোট বাড়াতে৷
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ উল আলম লেনিন ডয়চে ভেলেকে বলেন,‘‘ঐতিহাসিকভাবে রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব আছে৷ ১৯৪৭ সালে দেশভাগই হয় ধর্মের ভিত্তিতে৷ তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়৷ কিন্তু সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান আবার বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সুযোগ করে দেন৷''
কিন্তু প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগও তো এখন ভোটের রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করছে?
নূহ উল আলম লেনিন বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগ চায় ধর্ম রাজনীতি থেকে দূরে থাকুক৷ ব্যক্তিগত পর্যায়ে থাকুক৷ কিন্তু যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে, তা অল্প সময়ে দূল করা যাবে না৷ তাই আওয়ামী লীগকে কৌশলে কাজ করতে হচ্ছে৷''
অন্যদিকে বিএনপি নেতা এবং চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আহমেদ আযম খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব আছে৷ এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই৷''
তিনি বলেন, ‘‘বিএনপি ধর্মনিরপেক্ষ নয়, ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী৷ আর বিএনপি ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করে না৷ তবে ভোটের সময় সব দলই ধর্মকে ব্যবহার করে ভোটের বাক্সে সুবিধা করতে চায়৷ আওয়ামী লীগও চায়৷''
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷