1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘ব্যবস্থা না নেওয়ায় বেপরোয়া ইউএনওরা’

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক ইউনিটের প্রাথমিক স্তর হচ্ছে উপজেলা৷ আর উপজেলার প্রশাসনিক প্রধান হলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)৷

https://p.dw.com/p/4HJhG
Asien Bangladesch | Generalsekretariat | Hauptsitz
ছবি: bdnews24.com

কিন্তু তাদের অনেকের বেপরোয়া আচরণে বিব্রত খোদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়৷ আর সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশাসন নিয়ে বিরূপ ধারণা তৈরি হচ্ছে৷

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে তাদের বার বার সতর্ক করা হলেও কোনো ফল হচ্ছে না৷ এমনকি দেশের উচ্চ আদালত কয়েকজন ইউএনওকে ভর্ৎসনা করার পরও পরিবর্তন আসছে না৷

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ‘‘এ ব্যাপারে আইন থাকলেও সরকার অতিমাত্রায় প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না৷ ফলে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠছে৷’’

প্রশাসনের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তারা মনে করছেন, তারা ফৌজদারি অপরাধের মত ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছেন৷ এ ব্যাপরে প্রশাসনের দ্রুত নজর দেয়া উচিত৷

তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সচিব মো. আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীর রবিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান, ‘‘অভিযোগের সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেয়া হয়৷ সাম্প্রতিক তিনটি ঘটনায়ও তিনজন ইউএনওর বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে৷’’

ট্রফি ভেঙ্গে এবং নৈশপ্রহরী পিটিয়ে আলোচনায়

গত শুক্রবার বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার ইউএনও মেহরবা ইসলাম ফুটবল খেলার ট্রফি আছাড় দিয়ে ভেঙে আলোচনায় এসেছেন৷

সরকার প্রশাসনের অতিমাত্রায় নির্ভরশীল: মনজিল মোরসেদ

শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে উপজেলার চৈক্ষ্যং আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় মাঠে এই ঘটনা ঘটে৷ ফাইনাল খেলা শেষে পুরস্কার বিতরণের আগে তিনি দুই দলের বিতর্ককে কেন্দ্র করে দুইটি  ট্রফি আছড়ে ভেঙে ফেলেন তিনি৷ এই ঘটনার একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ইউএনও’র আচরণ নিয়ে তীব্র সমালোচনা চলছে৷

তার একদিন আগে গত বৃহস্পতিবার বগুড়া সদর উপজেলার ইউএনও সমর পাল উপজেলা প্রকৌশলী কার্যালয়ের নৈশপ্রহরী আলমগীর হোসেনকে লাঠি দিয়ে মারধর করে এখন আলেচনায়৷ অভিযোগ, মারধরে ওই নৈশপ্রহরীর হাত ভেঙে গেছে৷ নৈশপ্রহরীর  বিরুদ্ধে তার স্ত্রীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে ইউএনও এই কাণ্ড করেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে৷

আদালতের নিন্দা

বিভিন্ন সময়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের আচরণ নিয়ে দেশের উচ্চ আদালতও কথা বলতে বাধ্য হয়েছে৷

গত ২১ জুলাই কক্সবাজারের টেকনাফে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নির্মাণ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে স্থানীয় সাংবাদিক সাইদুল ফরহাদকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কায়সার খসরু৷

এর একটি অডিও প্রকাশ হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ হয়৷ ঘটনার তিন দিন পর ওই ইউএনওকে ওএসডি করা হয়৷ 

বিষয়টি তখন হাইকোর্টের নজরে এলে সাংবাদিকের সঙ্গে ইউএনও’র ভাষা ব্যবহারকে ‘মাস্তানদের চেয়েও খারাপ ভাষা’ বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট৷

আরো যতো অভিযোগ

স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের সঙ্গে খারাপ আচরণ, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তি, সাংবাদিকদের সঙ্গে অশোভন আচরণের মতো আরো অনেক অভিযোগ আছে ইউএনওদের  বিরুদ্ধে৷

৯ জুলাই মানিকগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুনা লায়লাকে ম্যাডাম না বলে আপা বলায় ব্যবসায়ী তপন চন্দ্র দাসকে লাঠিপেটা করে তার সাথে থাকা পুলিশ৷ ইউএনও একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় এই ঘটনা ঘটে৷

নোটিশ জারি করতে যাওয়া আদালতের দুই কর্মচারীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের জন্য ফরিদপুরের বোয়ালমারীর ইউএনও মো. রেজাউল করিমকে হাইকোর্টে তলব করে গত ৭ জুন৷

এপ্রিলে নেত্রকোনার কালমাকান্দা উপজেলায় ইউএনওকে স্যার না বলায় থানার ওসি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে হেনস্তা করেন৷

গত বছরের ৪ জানুয়ারি নওগাঁর বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলপনা ইয়াসমিনের কিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তি করারও অভিযোগ উঠে৷

গত বছরের আগষ্টে লালমনিরহাটের আদিতমারীর ইউএনও মুনসুর উদ্দিনের বিরুদ্ধে হুমকি ধমকি দেয়ার অভিযোগ উঠে৷ ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে নালা তৈরিতে আপত্তি জানালে ইউএনও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদেরকে ‘থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে’ দেয়া এবং ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দেন বলে অভিযোগ৷

বিধিমালা কী বলছে?

সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী, নাগরিকদের সঙ্গে যেকোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷

২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী অসদাচরণ বলতে বোঝানো হয়েছে- অসঙ্গত আচরণ, চাকরি-শৃঙ্খলা হানিকর আচরণ কিংবা শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণকে৷ এই আচরণবিধি এবং চাকরিবিধির প্রশিক্ষণ নিয়েই কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগ দিয়ে থাকেন৷

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীর রবিবার জানিয়েছেন, ‘‘সম্প্রতি বান্দরবানের আলীতদম ট্রফি ভেঙে ফেলা, বগুড়ায় নৈশ প্রহরীকে মরধোর এবং কুড়িগ্রামে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় যে তিনজন ইউএনওর নাম এসেছে তাদের সবার বিরুদ্ধেই তদন্ত চলছে৷ দায়ী প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷’’

এসব ঘটনা প্রশাসনকে বিব্রত করে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘যেকোনো খারাপ কিছুর জন্য সমাজ যেমন বিব্রত হয়, আমরাও বিব্রত হই৷ প্রত্যেক ঘটনার প্রেক্ষিতে সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে৷ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এমন কোনো নজির কিন্তু নেই৷’’

অতিরিক্ত সচিব আরো বলেন, ‘‘যদি ব্যক্তির দায় থাকে, তাহলে তো সরকার দায় নেবে না৷’’

সরকার প্রশাসনের অতিমাত্রায় নির্ভরশীল: মনজিল মোরসেদ

কেন এতো বেপরোয়া?

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ মনে করেন, পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে৷

তিনি বলেন, ‘‘ইউএনওদের আচরণে মনে হচ্ছে তাদের জন্য কোনো আইনকানুন প্রযোজ্য নয়৷ তারা বেপরোয়া হয়ে উঠছেন৷’’

তিনি মনে করেন, ‘‘গত ১০ বছরে পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে বেশি৷ আগে এরকম ছিল না৷ এর কারণ আইন-বিধিমালা থাকলেও তাদের এই আচরণের জন্য শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় না৷ তাদের ক্ষমতার কোনো কমতি হয় না৷ ফলে তারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে৷’’

তার কথা, ‘‘সরকার এখন প্রশাসনের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল  হয়ে পড়েছে৷ তারাই যেন সরকার চালাচ্ছে৷ জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা তেমন নাই৷ তাই তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না৷ ফলে মাঠ প্রশাসনের প্রতি সাধারণ মানুষ বিতশ্রদ্ধ হয়ে উঠছে৷’’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিানিয়র সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘‘সম্প্রতি যে তিনটি ঘটনা ঘটেছে তা ফৌজদারী অপরাধ৷ এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না৷ এক ইউএনও নৈশপ্রহরী কেন কারুর গায়েই হাত তুলতে পারেন না৷ তিনি আইন জানে না৷ এটা ফৌজদারী অপরাধ৷  সবার সামনে ট্রফি ভেঙ্গে ফেলা কোনো অফিসারসুলভ আচরণ নয়৷ আর প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ইউএনও চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন৷’’

তিনি বলেন, ‘‘এই ঘটনাগুলো কয়েকদিনের মধ্যে ঘটেছে৷ এর আগেও ঘটেছে৷ তারা চাকরি বিধিমালা জানেন, আইন জানে না৷ তাদের প্রশিক্ষণে এ বিষয়গুলো পড়ানো হয়৷ তারপরও তারা এমন আচরণ করছেন৷ আমার মনে হয় তাদের প্রশিক্ষণ এবং মোটিভেশনে আরো জোর দেয়া দরকার৷ আর ইউএনও পোস্টিং-এর আগে আরো ভালোভাবে যাচাইবাছাই করা দরকার৷’’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, গত দশ বছরে প্রশাসনের প্রায় তিন হাজার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, অনৈতিক আচরণসহ বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া গেছে৷ এসব অভিযোগের ভিত্তিতে অন্তত পাঁচশ’র মতো বিভাগীয় মামলা হলেও এগুলোতে একশ'র মতো কর্মকর্তাকে গুরু ও লঘুদন্ড দেয়া হয়েছে৷ তবে সর্বোচ্চ শাস্তি চাকরিচ্যুতির নজির একেবারেই কম৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান